সঙ্গীত সাহিত্য ও ভারতবর্ষ

সঙ্গীত সাহিত্য ও ভারতবর্ষ

অমিতায়ু চক্রবর্তী

সাহিত্যের মূলতঃ দুটি রূপ। একটি মৌখিক এবং অপরটি লিখিত। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষা তথা সাহিত্য ছিল তার মৌখিক রূপেই। লিখিত রূপে সাহিত্যকে আমরা অনেক পরে পেয়েছি। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে মনে করা যেতে পারে সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ভারতে সঙ্গীতের চর্চা হয়ে আসছে। সেসময়ের প্রাপ্ত লিপি ও পোড়া মাটির মূর্তি (The Dancing Girl) তার সাক্ষ্য বহন করছে। ভারতে সঙ্গীতচর্চা ঠিক কবে থেকে শুরু হল তা নির্ণয় না করা গেলেও সেই শিক্ষার মাধ্যম যে লিখিত ছিল না, তা সহজেই অনুমেয়। অতএব বলা যেতে পারে মৌখিক চর্চা থাকলেও উপমহাদেশ বহুদিন পর্যন্ত নিরক্ষর হয়ে থেকেছে সঙ্গীত সাহিত্যের ক্ষেত্রে। এই নিরক্ষরতা নিয়েই উপমহাদেশ অনেক দূর এগোলেও অপূরণীয় ক্ষতিও হয়েছে তার। যেমন বহু সুর হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে, তেমনি স্বরলিপিবদ্ধ না থাকায় বিকৃত হয়েছে বহু সুর, যে বিকৃতির ক্ষতিপূরণ আজকে কার্যত অসম্ভব। 

সঙ্গীত সাহিত্যের অন্যতম মূল উপাদান স্বরলিপি, যা বস্তুত পাশ্চাত্যের সম্পদ। স্বরলিপি বলতে কিছু বিশেষ সঙ্কেতের সমষ্টিকে বোঝানো যেতে পারে যা দিয়ে কোন নির্দিষ্ট সুরকে চিহ্নিত করা সম্ভব। মধ্যযুগীয় ইউরোপে স্বরলিপি পদ্ধতি জন্ম ও বিকাশলাভ করে। ক্যাথলিক চার্চ সমগ্র ইউরোপে প্রথম স্বরলিপির ব্যবহার শুরু করে “প্লেইনচ্যান্ট মেলোডি”র স্বরলিপি প্রস্তুত ও প্রচার করে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল যাতে সমগ্র ইউরোপে এই সঙ্গীত অবিকৃতভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করতে পারে। তবে, লিখিত স্বরলিপির প্রথম নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় সুমেরে (বর্তমানে ইরাক)। সেখানে ঐতিহাসিক খননকার্যে প্রাপ্ত একটি ফলকের ওপরে খোদাই করে অঙ্কিত একটি অসমাপ্ত স্বরলিপি পাওয়া যায়। এরপর, স্বরলিপি পদ্ধতির নানা সময়ে নানা বিবর্তন হলেও (যে বিবর্তনের ধারা আজও বহমান) তার মূল কাঠামোটি প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গিয়েছে। 

উনিশ শতকের আগে ভারতবর্ষে স্বরলিপির প্রচলনের কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না। উনিশ শতকে ইউরোপের নবজাগরণের ঢেউয়ের দোলা কালাপানি পার করে এই সুদূর উপনিবেশেও পৌঁছে যায়। সেই ঢেউয়ের সাথেই ভারতীয় সঙ্গীতজগতেও প্রবেশ করে স্বরলিপি। ভারতের তৎকালীন রাজধানী, কলকাতার জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটার দুই ঠাকুর পরিবার ভারতে স্বরলিপি পদ্ধতি প্রচারের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখে। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রথম এই চেষ্টা শুরু করেন। তিনি নিজে দেশীয় ও পাশ্চাত্য উভয় প্রকার সঙ্গীত শিক্ষা করেন এবং রামমোহনের মত খানিকিটা ‘হিউম্যানিস্ট’ পন্ডিতের ভূমিকা পালন করেন সঙ্গীত সাহিত্যের ক্ষেত্রে। তিনি সঙ্গিতের প্রাচীন শাস্ত্র উদ্ধার করে নতুন ও যুগোপযোগী মলাটে তার ব্যাখ্যা ও তা প্রচারের চেষ্টা করেন। তাঁর কাজটি যদিও ছিল আপাতভাবে সংরক্ষণমূলক এবং সঙ্গীতের পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় বাদ্যযন্ত্রকেও তিনি তাঁর সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসেন। ওস্তাদ ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর সহায়তায় তিনি প্রাচীন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বরলিপি তৈরি করান ও তার প্রচার করেন। শৌরীন্দ্রমোহনের রচিত গ্রন্থ ‘সঙ্গিত সার’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে। প্রায় একই সময়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আ-কার মাত্রিক’ স্বরলিপি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যা পরবর্তীকালে সেই পরিবারের আর কৃতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে আরও পরিশীলিত রূপ লাভ করে। সেই পরিমার্জিত রূপ আজও বাংলা স্বরলিপির মান্য রূপ হিসেবে পরিচিত। স্বরলিপির বিবর্তনের এই ধারায় অন্তিম পুরুষটি হলেন কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪৬-১৯০৪)। স্বরলিপির ধারাপাত বদলের এই ভাঙাগড়াকে তিনি একটি স্থায়ী রূপ দেন। ভারতীয় সঙ্গীতে ইউরোপীয় ‘স্টাফ নোটেশন’ তিনিই প্রথম প্রয়োগ করেন এবং তিনিই প্রথম প্রস্তাব করেন যাতে আমাদের উপমহাদেশীয় গুরুমুখী  সঙ্গীত স্বরলিপি ভিত্তিক হয় এবং আমাদের দেশেও সঙ্গীত সাহিত্য গড়ে ওঠে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শুধু স্বরলিপি প্রবর্তন নয়, এই কন্ঠশিল্পী তথা সেতার ও পিয়ানবাদক নিজের সাঙ্গীতিক জ্ঞান ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে সঙ্গীত নিয়ে অনেক সফল নিরীক্ষা করেন যার অন্যতম ফসল ভারতীয় সঙ্গীতে ঐকতান (chorus) ও স্বরসঙ্গতি (harmonics) এর বহুল ও সফল ব্যবহার। 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও