চড়ুকে পিঠ (পর্ব ২) রাঁচি-রাজারাপ্পা

 "পাগলাগারদ কোথায় আছে" তা মৌচাক ছায়াছবির এই বিখ্যাত গানটি শোনার পর সকলেই জেনে গিয়েছেন। তবে রাঁচি মানেই শুধু পাগলাগারদ নয়। রোব্বারে খাসি আর সুদূরের পিয়াসী এই দুয়ের ফারাক যদি আপনার জানা থাকে, তবে একবার ঘুরে আসতেই পারেন ঝাড়খন্ডের এই ছোট্ট শহরে। ভিজে জবজবে পশ্চিমবঙ্গীয় স্বত্ত্বা খানিকটা হলেও শুকোনো যেতে পারে এই অছিলায়। পাথুরে টিলা আর তার ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে আসা জলের ধারা, মসৃণ পাথরের আলগা প্রান্তে শ্যাওলার টিকে থাকার লড়াই আপনাকে জীবনযুদ্ধে অণুপ্রাণিত করতে পারে। যদিও স্থানীয় মানুষের মতে রাঁচি ভ্রমণের আদর্শ সময় শীতকাল, তবে এই ব্লগের লেখক আপনাকে উপদেশ দেবে বর্ষায় যেতে। সীতা, জোনহা, হুন্ড্রু জলপ্রপাতের পূর্ণ যৌবন দেখার জন্যে এর থেকে ভাল সময় হয় না। জলপ্রপাতে কৃত্রিম যে স্নানাগার আছে, তাতে জলকেলিটা অবশ্য বর্ষায় সিলেবাসের বাইরে রাখবেন নতুবা গড্ডালিকাপ্রবাহে ভেসে যাবার প্রবল সম্ভাবনা। কিন্তু পালাবার পথ নাই, যম থুড়ি পাথর আছে পিছে। স্থানীয় মানুষদের পরামর্শ মেনে নিরাপদ শীতকালকেও বেছে নিতে পারেন রাঁচিদর্শনের জন্যে তবে সেসময় জলপ্রপাতের ডায়েট করা ক্ষীণকায়া রূপে আপনার চক্ষের তথা বক্ষের তৃষ্ণা মিটবে কি না তা বলা শক্ত। 





প্রথমদিন সীতা, জোনহা, হুন্ড্রু জলপ্রপাত দেখে ঘুরে আসতে পারেন রাজারাপ্পা। পথেই পড়বে গেটালসউড জলাধার। করোনার দাপটে রাজারাপ্পা সহ রাঁচির সমস্ত মন্দিরের দরজাই ভক্তদের জন্যে বন্ধ। ভগবান সংক্রমণের ভয়ে মাস্ক পরে আছেন কি না, তা এমন সময়ে গেলে প্রত্যক্ষ করা হবে না আপনার। মন্দির বন্ধ থাকলেও পুজো বন্ধ নেই। মন্দিরের মূল দরজার কাছে ডিস্ট্যান্স এডুকেশনের মত ডিস্ট্যান্স পুজোর ব্যবস্থা। ভক্তির পরাকাষ্ঠা থাকলে ভক্তির হটস্পটে কিছু নৈবেদ্য অর্পণ করতেই পারেন। রাজারাপ্পা মন্দিরের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ভৈরবী নদী। বর্ষা ছাড়া অন্য ঋতুতে গেলে এই নদীতে নৌকাবিহারের অখন্ড সুযোগ পেতে পারেন। ভরা বর্ষায় সেই পরিষেবা বন্ধ থাকে। প্রবল গর্জন আর জলের টান দেখলে তার সহজ কারণটি আপনিও বুঝতে পারবেন। সেই ভীমকায় স্রোতে নৌকাবিহার করতে গেলে নৌকাসমেত বিহারে পৌঁছে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয়দিন জগন্নাথ মন্দিরে বাইরে থেকে প্রণাম জানিয়ে দেখে আসতে পারেন দশম জলপ্রপাত। সেখান থেকে পঞ্চঘগ জলপ্রপাত দেখে পাহাড়ি মন্দির হয়ে চলে যান পত্রাতু উপত্যকা। বর্ষায় গেলে আপনাকে ধাওয়া করতে পারে একরাশ জলভরা মেঘ। গাড়ির গতি বাড়িয়ে তাদের হারাতে না পারলে আপনাকে ভিজতে হবে আগাপাশতলা। পত্রাতুর রাস্তা দেখতে দেখতে আপনার মনে পড়ে যেতেই পারে উত্তরবঙ্গের কোন চড়াই রাস্তা।

তৃতীয় দিন চিড়িয়াখানা দেখে চলে যান টেগোর হিল বা স্থানীয়ভাবে মোরাবাদী পাহাড়। গোটা রাঁচি শহরটাকে পাখির চোখে দেখার একমাত্র ঠিকানা এটিই। ঠাকুর পরিবারের এক কৃতি সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসস্থান ছিল এটি। জীবনের শেষ দিনগুলি তিনি এখানেই অতিবাহিত করেছিলেন বলে জানা যায়। সেই বাসভবন আজ অবশিষ্ট না থাকলেও পাহাড়টি জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা ভাষ্কর্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন। টেগোর হিল দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এলে চলে যান কাঁকে জলাধার ও রক গার্ডেন। সেখানে সন্ধ্যে কাটিয়ে এবার ফেরার পালা। 

পর্যটকের দ্রষ্টব্যের বাইরেও রাঁচিতে রয়েছে স্বনামধন্য উন্মাদ আশ্রম সাধারণত অনুমতিসাপেক্ষে পরিদর্শনের ব্যবস্থা থাকলেও করোনা অতিমারির প্রকোপে আপাতত সেই ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে দেবকমল বার্ন হাসপাতাল। এখানে আগুনে পুড়ে যাওয়া অত্যন্ত সংকটজনক রোগীদের চিকিৎসা করা হয়। 

কেজো কথা- হাওড়া থেকে রাঁচিগামী ট্রেনে চেপে রাঁচি অবতরণ। স্টেশন থেকে বেরোতেই আপনাকে জামাই আদর করতে অপেক্ষায় থাকবে প্রচুর অটো, গাড়ি ও রিকশা। আগে থেকে হোটেল বুকিং না করা থাকলে তাদের সহায়তায় সুলভে হোটেল পেতে পারেন। রাঁচি ভ্রমণের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করা না থাকলে ৭৯০৩৪৪৫৮১০ নম্বরে বিজয় কুমার-কে ফোন করতে পারেন। প্রয়োজনে এই ব্লগের লেখকের নামও উল্লেখ করতে পারেন। রাঁচি পরিদর্শনে উক্ত ভদ্রলোক আমার সারথি ছিলেন। দৈনিক ১২০০ টাকা এবং কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা মূল্যে ইনি গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেন। 

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও