কেশনগরের দুগ্গোপুজো

"রূপং দেহি, ধনং দেহি, জয়ং দেহি, দ্বিষোজহি"- এই প্রার্থনা যাকে প্রতিবছর বুঝে এবং না বুঝে জানিয়ে আসছি, তিনি মহামায়া দেবী দুর্গা। দেবী বলা হয়ত ঠিক হল না, তিনি আপামর বাঙালির ঘরের মেয়ে। বহুদূরের শ্বশুরঘর থেকে মাত্র পাঁচদিনের ছুটিতে প্রতিবছর বাপের বাড়ী আসেন তিনি। দূরে বিয়ে হয়ে চলে যাওয়া মেয়ে বৎসরান্তে বাড়ী ফিরলে তাকে নিয়ে যে যে আদিখ্যেতা করা সম্ভব বাপ-মা এর পক্ষে, তার সবেরই শাস্ত্রীয় নিদান আছে দুর্গাপুজার আচারে।সবার মঙ্গলার্থে যেদিন থেকে এই বাঙালির ব্যক্তিগত আনন্দটিকে কর্পোরেট তথা সরলার্থে বারোয়ারি করে ফেলা হয়েছে, তবে থেকেই হারিয়ে গেছে মা-মেয়ের খুনসুটিগুলো। কলকাতা থেকে নামমাত্র দূরত্বে নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর নামে এই উপশহরটির জন্ম ও বিকাশ। কৃষ্ণনগর বিখ্যাত তার মৃৎশিল্পের জন্যে। তাই মৃন্ময়ী যে সেখানে অপরূপা হবেন, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন বৈষ্ণব, অথচ তার অনুরাগ ছিল মাতৃশক্তিতে। তাই শাক্তমতে প্রচলিত পূজা-পদ্ধতিতে বৈষ্ণবীয় সংশোধন করে তিনি দুর্গাপুজো শুরু করেন। তবে শুধু রাজা কৃষ্ণচন্দ্রই নন, কৃষ্ণনগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এমনই আরও অনেক শতাব্দী প্রাচীন পুজো। বারোয়ারি লঘুতা সেখানে সাম্যের গান গায় না। একেকটি পরিবারে একেকটি গল্পে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। একই ছাঁচের মৃন্ময়ীর চিন্ময়ী আদল তাই বারবার বদলে যায় আন্তরিকতার আবহে। 

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর পুজো 
যার হাত ধরে এই পুজোর শুরু, সেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ীর পুজো তথা রাজবাড়ীর পুজো দিয়েই এই পুজো পরিক্রমা শুরু করা যেতে পারে। এই দুর্গামূর্তির আদল আমাদের চেনা ধাঁচের থেকে একটু আলাদা। এখানে দেবী দুর্গার বাহন যে চতুষ্পদ প্রাণীটি, তার ধড়টা সিংহের মত হলেও মাথাটা বা মুখটা ঘোড়ার মত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়; রমেশ শাস্ত্রী লিখিত শাক্তমতের দুর্গাপূজার যে কয়েকটি বৈষ্ণবীয় সংস্কার সাধন করেন, তার মধ্যে এটি অন্যতম। রাজবাড়ীটি বর্তমানে ভগ্নপ্রায় হলেও তার দুর্গামন্ডপের কারুকার্য অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে আধুনিক যে কোন পুজো মন্ডপ-কে। ঠাকুর দালান, চন্ডীমন্ডপ ও খিলানের গায়ের কারুকার্য কোন এক অলৌকিক মন্ত্রবলে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সুদূর অতীতে। 

নীলদুর্গা (২৪ বছর) 
আদি নীলদুর্গা (২৮৭ বছর) 
রাজবাড়ী থেকে সামান্য দূরত্বে রয়েছে নীলদুর্গা বাড়ী। এহেন নামের কারণ এই বাড়ীতে পূজিতা দেবীর গাত্রবর্ণ নীল। কথিত আছে বহু পূর্বে কুমোরের ভুলে অন্ধকারে দেবীর গায়ে নীল রঙ লাগিয়ে ফেলা হয়েছিল। পুজোর আগে এহেন বিপর্যয়ে যখন পুজো বন্ধ হবার জোগাড় হয়, তখন দেবী বাড়ীর কর্তাকে স্বপ্নে আদেশ দেন এই নীলরূপা দেবীকেই পুজো করতে। সেই থেকে এভাবেই দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন এ বাড়ীতে। এই পুজো শাক্তমতের। বর্তমানে এই পুজো দুটি অংশে বিভক্ত। একটি আদি নীলদুর্গা ও অপরটি বিভক্ত পুজোটি। আদি নীল দুর্গার পুজোর বর্তমানে যিনি কর্ণধার, তিনি জীবনলাল চট্টোপাধ্যায়। এই পুজোয় দেবীর সামনে পাঁঠাবলি হয়। দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় মাছ সহযোগে। দশমীতে ডালের বড়া ও কচুর শাকের সঙ্গে পান্তা ভোগ খাইয়ে মা-কে বিদায় জানানো হয়। সরকারি নিষেধাজ্ঞায় বর্তমানে মহিষ বলি বন্ধ হওয়ায় বাড়ীর যিনি বড় ছেলে, তিনি হাত কেটে রক্ত দিয়ে দেবীকে অর্ঘ্য দেন। বলি হয় ষড়ঋপুর। একটি চালের পুঁটলীকে ষড় ঋপুর প্রতীক রূপে ৯ কোপে কাটা হয়। বরিশালের বামরাইল গ্রামে এই পুজো শুরু হয়। ওদেশের রীতি মেনে কার্ত্তিক ও গণেশের অবস্থানগত বৈপরীত্য দেখা যায় এই দেবীমূর্তিতে। দেশভাগের আগে ১৯৪৬ সালে এই পরিবার কৃষ্ণনগরে চলে আসেন এবং ১৯৪৮ থেকে এ দেশে পুজো শুরু হয়। এদেশ পুজো শুরু করেন এদের পূর্বপুরুষ সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।  ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই পুজো অবিভক্ত রূপেই হয়ে এসেছে, কিন্তু সেই বছর পারিবারিক আচারের বিরোধিতা করে কুমারী পুজো অনুষ্ঠিত হলে এই বাড়ীর বড়ছেলে অনন্তলাল চট্টোপাধ্যায় বাড়ীর পুরোনো পুজো থেকে বিযুক্ত হয়ে আলাদাভাবে পুজো করতে শুরু করেন ১৯৯৮ সাল থেকে। এই পুজোটি মূল বাড়ীর অদূরেই একটি দুর্গামন্ডপে অনুষ্ঠিত হয়। এই পুজোও শাক্তমতে হয় কিন্তু এই পুজোয় বলির প্রথাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

সাহাবাড়ীর পুজো (২৫১ বছর) 
নীলদুর্গা বাড়ীর পর এবারে সাহাবাড়ীর পুজো। বাংলাদেশের পাবনা অঞ্চলের নিবাসী এই পরিবারের পুজোর বয়স ২৫১ বছর। এই পুজো শুরু করেন জানকী হাজারি। জমিদারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে হাজার টাকা দিয়ে একটি লাউ কিনেছিলেন বলে তিনি 'হাজারি' উপাধি পান। বর্তমানে এই পুজোর কর্ণধার অসীমকুমার সাহা। তিনি কৃষ্ণনগর অঞ্চলের একজন সম্মানীয় রাজনীতিক। এই পুজো বৈষ্ণব মতে হলেও এখানে দেবীর বাহন স্বরূপে অর্থাৎ সিংহরূপেই বিরাজমান। এই পুজোতেও গণেশ দেবীর ডানদিকে এবং কার্ত্তিক দেবীর বাঁদিকে অবস্থিত। বৈষ্ণব মতের পুজো বলেই বলি বা আমিষ ব্যবহার হয় না পুজোয়। 
৩ ইঞ্চির দুর্গাবাড়ী (২৪৭ বছর) 

দাসবাড়ীর পুজো কৃষ্ণনগরে 'তিন-ইঞ্চির দুর্গাপুজো' নামেই অধিকতর পরিচিত। ১৭৭৪ সালে ফরিদপুর জেলার উজানচর গ্রামে এই পুজো শুরু করেন গঙ্গারাম দাস। দেশভাগের সময় এপারে চলে আসে পরিবারটি। কৃষ্ণনগরে পুজো শুরু হয় ১৯৫২ সালে। শুরু করেন বিজয়কুমার দাস। বিজয় দাস ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তিন-ইঞ্চির পিলার ব্যবহার করে তিনি এই বাড়ী ও সংলগ্ন দুর্গামন্ডপ তৈরি করেন। এই ব্যতিক্রমী নির্মাণ থেকেই এই বাড়ীর এরূপ নামকরণ। এই বাড়ীর পুজোতেও কার্ত্তিক-গণেশের বিপরীতমুখী অবস্থান। এই পুজোর বিশেষত্ব এই যে, সপ্তমীর রাতে কালীপুজো হয়ে সেই প্রতিমা বিসর্জনের পরেই দুর্গাষ্টমীর পুজো শুরু হয় এ বাড়ীতে। 

রায়বাড়ীর পুজো (আনুমানিক ৩০০ বছর) 
রায়বাড়ীর পুজো রাজবাড়ীর পুজোর সমসাময়িক। এর সঠিক বয়স জানা যায় না। তবে ভৈরবচন্দ্র রায় এই বাড়ীর পুজো শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের তিন মেয়ের বিয়ে হয় এই বাড়ীতে। মূলত তাদের উদ্যোগেই এই বাড়ীর পুজো শুরু হয়। বর্তমানেও বাড়ীর মেয়েরাই এই পুজোর প্রধান উদ্যোক্তা। একেবারে পুরুষবর্জিত না হলেও এই রায়বাড়ীর পুজো ভীষণরকমভাবেই নারীকেন্দ্রিক। এই পুজো শাক্তমতের এবং বলিপ্রথা আজও বর্তমান এই পুজোয়। 

পুজো মানেই বারোয়ারির জগঝম্প নয়। চোখধাঁধানো আলো, কানফাটানো শব্দের বাইরেও দেবী আছেন। কর্পোরেট অসুরদলনী নয়, দুর্গা সেখানে ঘরের মেয়ে। বহুদূরের শ্বশুরবাড়ী থেকে বৎসরান্তে বাপের বাড়ীতে আসা দেবী সেখানে ভীষণ আটপৌরে। বাবা-মা এর আদর মেখে আবার একবছরের সাংসারিক জোয়ালে ফেরত যেতে হয় তাকে। আসা যাওয়ার মাঝের এই আবেগটুকুতেই ধরা আছে খাঁটি উৎসবটুকু। সেখানে দেখনদারি নেই, আছে নিখাদ ভালোবাসা। আর তাতেই দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। মাটির পুতুলের কেশনগরে তাই মৃন্ময়ী নয়, চিন্ময়ীরূপে পূজিতা হন দেবী, বাবা-মায়ের আদরে ভরে ওঠে, সেজে ওঠে আমাদের বাড়ীর মেয়ে। 

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও