কবিতার অনুবাদ: কবির যাপনান্তর

বিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— "a poem cannot be translated, it can only be re-lived in a different atmosphere"। এই মন্তব্যকে যদি সত্যি বলে মেনে নিই আর সেইসঙ্গে কবি ও কবিতার যদি একটি অভেদ কল্পনা করি তাহলে যে প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে তা হল, কবিতার অনুবাদ যদি অসম্ভব হয়, তার সময়োচিত সংস্কারের একমাত্র পথ যদি হয় তার যাপনান্তর, তাহলে কবির ক্ষেত্রেও কি সেই একই সূত্র প্রযোজ্য হবে? তাকেও কি সময়ের বা দেশকালের ব্যবধানে সংস্কার করে নিতে হবে প্রাসঙ্গিকতার মাপকাঠিতে? কবিতার অন্তরে কবির যতটুকু যাপন বন্দী হয়ে থাকে, সেই যাপনেরই শরিক হয়ে ওঠেন পাঠক। দেশ-কাল-সময়ের ব্যবধানে কবির সঙ্গে পাঠকের সেখানে যতটুকু ব্যবধান, সেই শূন্যস্থান পূরণেই মধ্যস্থতা করে অনুবাদ। তাই অনুবাদকে বলা চলে কবি ও কবিতার সময়োচিত সংস্কার। অতঃপর প্রশ্ন আসে, সংস্কার আসলে কী? আর কবিতা বা কবির সংস্কার আদপেই কেন প্রয়োজন? জৈমিনি সূত্রে বলা হয়েছে, "সংস্কারো নাম স ভবতি, যস্মিন। জাতে পদার্থ ভবতি যোগ্যঃ কস্যচিদ অর্থস্য।।"। এক্ষেত্রে যে যোগ্যতার প্রশ্নটি উঠে এসেছে তার ব্যাখ্যা শাস্ত্রকার কুমারিল ভট্টের মতে কতকটা এই রকম যে, সংস্কারের মাধ্যমে একটি পদার্থ বৃহত্তর প্রয়োজনের যোগ্য হয়ে ওঠে। 


কবিতার ক্ষেত্রে সেই বৃহত্তর প্রয়োজনটি আসলে কী, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে এই কৈফিয়তটি প্রয়োজন, যে কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা। চারপাশের দ্রুত পরিবর্তনশীল সময় এবং দ্রুততর বদলে যাওয়া দৃশ্যপটের হিসেবী সমীকরণের একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ আজও দুই বাংলার বাঙালি মননের চালে ডালে এবং ট্র‍্যাফিক সিগন্যালে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন ১৬২ বছর ধরে। রবীন্দ্রবিরোধী যেসব সবুজপত্র আজও বিবর্ণ হয়নি, তারা বলতেই পারেন যে রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুর পদবি-বলে বাঙালি মনের সিংহাসনে অচলায়তন খুলে বসেছেন এবং সেই আয়তনের বজ্রশুদ্ধি ব্রত ৭৭৭ বার পূর্ণ হলেও তা একইরকম অচল এবং অনড় হয়েই থাকবে। পঞ্চকের ভূমিকায় যিনি সেই অচলায়তনের নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তাদের যাচাই করে নিতে চেয়েছিলেন ভাঙনের কষ্টিপাথরে, সময়ের কষ্টিপাথরে তাঁরই বা পরীক্ষা বাকি থাকে কেন?


সাহিত্যের প্রায় সবকটি সংরূপেই রবীন্দ্রনাথের পদচিহ্ন স্বত্বেও তাঁর মূল পরিচয় কবি হিসেবেই. বিশ্বগীতিকার বা বিশ্বনাট্যকার রবীন্দ্রনাথ বিশ্লেষণী সংজ্ঞায় বিরল। বিশ্বকবির গলার মালায় তাই ঢাকা পড়ে গিয়েছে তার বুকের অন্যতর স্পন্দনগুলি। একটি গানে তিনি লিখছেন, " আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর, তোমার প্রেম হত যে মিছে"। তেমনি বিশ্বকবির কবিতাগুলি যদি বিশ্বের পাঠকের সমাদর না পেত, তবে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হতে পারতেন কি না সন্দেহ।  বাংলার কুঁড়েঘর থেকে বিশ্বজয়ী যাত্রার পথে যে অগণ্য বাধা তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছিল, তার মধ্যে ভাষাগত সমস্যা ছিল অন্যতম। প্রথাগত শিক্ষার অভাবেই হোক বা ঔপনিবেশিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণেই, ইংরেজি ভাষায় কোনদিনই তেমন সড়গড় হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রভক্তরা এই মন্তব্যের বিরোধিতায় রে রে করে তেড়ে আসতেই পারেন, কিন্তু এই স্বীকারোক্তি কবির নিজস্ব। নিজের সৃষ্টিকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে ভাষান্তরের যে মোড়কে তাকে সাজালেন কবি নিজে এবং তাঁর অনুমোদিত অনুবাদকেরা, সেই মোড়ক আড়ে-বহরে দুদিকেই হল ছোট। রাঙতার রসদ না থাকায় তিনি শুরু করলেন তার সৃষ্টির অঙ্গহানি। স্থান-সংকুলানের শর্তে বাদ গেল তার অলঙ্কার, ছন্দ, সুর। পড়ে রইল কেবল ভাব, যা অনুবাদ করতে বিশেষ বেগ পেতে হল না সেই অপটু অনুবাদকদের। প্রথম মহাযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসলীলায় ক্লান্ত ইউরোপ রবীন্দ্র-সৃষ্টির সেই অপরিসর খন্ডাংশেই খুঁজে পেল জীবনের রসদ। ইউরোপীয় মাতামাতির ফলস্বরূপ ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ একই সঙ্গে বিদেশে স্বীকৃতি ও স্বদেশে পরিচিতি পেলেন। 'দেবেন ঠাকুরের ব্যাটা' খেতাব ঘুচে রবীন্দ্রনাথ; রবীন্দ্রনাথ নামেই পরিচিত হলেন। এই অনুবাদের পালা আরম্ভ হয়েছিল ১৮৯০ সাল নাগাদ। কবি তখন তাঁর 'মানসী' কাব্যের অন্তর্গত 'নিস্ফল কামনা' কবিতাটি অনুবাদ করছিলেন। কোন কারণে সেই অনুবাদ অসমাপ্ত থেকে যায়। এরপর ১৮৯০ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে রবি দত্ত, লোকেন পালিত, অজিত চক্রবর্তী এবং রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার বিভিন্ন রচনাকে ভাষান্তরিত করতে প্রবৃত্ত হন। এই চেষ্টারই দীর্ঘসূত্রতায় ইউরোপগামী জাহাজে নিজের একাধিক কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে সেই পান্ডুলিপি তিনি পড়তে দেন তার বন্ধু উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে। তারপর তা কীভাবে ইয়েটস-এর আগ্রহে এবং ইন্ডিয়া সোসাইটির অর্থানুকূল্যে ছাপা হয় এবং সেই বই পাঠক ও সমালোচক মহলে সাড়া জাগায়, তা অনুসন্ধিৎসু পাঠকমাত্রেই জানেন। সমকালীন ইউরোপে সেই অনুবাদিত কবিতাগুলি প্রবল সমাদর পেলেও তা অনাদরে পর্যবসিত হতে দেরি হয়নি৷ রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে বরেণ্য কবি এলিয়ট সাফ জানান, যে রবীন্দ্রনাথকে তিনি কবি বলে মনে করেন না। সাফল্যের অনতিপরেই রবীন্দ্রনাথ যে ইউরোপীয় সাহিত্য আসরে কেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন, তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জানিয়েছেন এর জন্যে সর্বাপেক্ষা বেশি দায়ী কবি স্বয়ং। ভাষান্তরিত করতে গিয়ে নিজের ইংরেজি ভাষার সীমিত পটুত্বে তিনি বহুলাংশে খর্ব করেছেন তাঁর সৃষ্টিকে। মূল রচনাকে সংকুচিত করে চিত্রকল্পের পথ অবরোধ করে তিনি ভাবকল্পকে প্রকাশের পথ করে দিয়েছেন। ইয়েটস গীতাঞ্জলির গ্রন্থাকারে প্রকাশের অনতিপরেই রবীন্দ্রনাথকে যে তাঁর ইংরেজি ভাষায় অজ্ঞতা নিয়ে দু-কথা শুনেছিলেন, তা নৈতিকতার বিচারে নিন্দনীয় হলেও অসত্য ছিল না। পরবর্তীকালে রবীন্দ্র-গবেষক উইলিয়াম রাদিচে-ও রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদগুলিকে তাঁর নিজের সৃষ্টির প্রতি করা অবিচার রূপেই অভিহিত করেছিলেন। এ বিষয়ে নাট্যকার ফ্রীডরিশ ড্যুরেনমাটের উক্তিও স্মর্তব্য। তাঁর মতে, ইংরেজির মধ্যবর্তিতায় তাঁরা পেয়েছেন একজন ভুল রবীন্দ্রনাথকে, এখন অনুবাদকের কর্তব্য মূল রবীন্দ্রনাথকে ভাষান্তরে নিয়ে আসা।


এই ভগ্নচিত্রের বিপ্রতীপে একটি পূর্ণতর চিত্রও রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষার অপটু প্রয়োগে তাঁর কবিতার যে অনুবাদ করেছিলেন, সেই সহজ অনাড়ম্বর অনুবাদ তাঁর বিশ্বজয়ের সারথি হয়ে ওঠে। অলঙ্কার সজ্জিত, ব্যাঞ্জনাবহুল কবিতাগুলির সরল অনাড়ম্বর ইংরেজি অনুবাদ সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অনুবাদকদের কাছে সহজে অনুবাদযোগ্য হওয়ায় তাঁর সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। যে ইংরেজি ভাষা তার বিশ্বজয়ের মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল, সেই ভাষার জোরেই রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেলেন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে। বাংলা ভাষার আকর রবীন্দ্রনাথ ও নড়বড়ে ইংরেজিতে অনুবাদিত ইউরোপীয় রবীন্দ্রনাথের পরে জন্ম নিল থার্ড টেগোর, যা দেশ কালের সীমার অতীত। রবীন্দ্রনাথ কৃত ইংরেজি অনুবাদগুলি সম্পর্কে রাদিচের মত- "Tagore's translations are his own word, and such are durable and authentic as his writings in Bengali"। আর সেই একই কারণে সারা বিশ্বের অনুবাদকেরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে বাংলা মূল কবিতাগুলিকে এড়িয়ে কবির করা সহজ ইংরেজি অনুবাদগুলিকেই বেছে নিয়েছেন আকর হিসেবে। মাত্র কুড়ি বছরের ব্যবধানে রাদিচে-র মতও বদলে গিয়েছে নাটকীয়ভাবে। কুড়ি বছর আগে তাঁর মতে যে ইংরেজি অনুবাদগুলি ছিল মূল কবিতার প্রতি অনাচার, সেগুলিই কুড়ি বছর পরে তাঁর মনে হয়েছে ইংরেজি ভাষাকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের উপহার। এই পরিবর্তনটিও সেই কবিতার অনুবাদের সূত্রকেই মনে পড়িয়ে দেয়। শব্দগুলি অপরিবর্তিত থাকলেও সময়ের স্রোতে তার যাপনান্তর হয়েছে। এ-ও একরকমের সংস্কার, শুধু প্রথাগত অভিমুখের বিপ্রতীপে এর গতি।  রবীন্দ্রনাথ কবিতাকে বলেছিলেন Benevolent curiosity-র ফলাফল যা পর্যবসিত হয় Profundity of sympathy-তে। এই হঠাৎ কৌতুহল থেকে অতিগভীর সংবেদনে যাত্রার যে পথ, অনুবাদের কর্ষণে আসলে সংস্কৃত হয় সেটাই। শুধু শব্দের সুবিন্যস্ত সারিই কবিতা নয়, তাই তার অনুবাদে শুধু দোভাষীর দক্ষতা যথেষ্ট হতে পারে না। যেখানে ভাষা কোন নির্দিষ্ট অর্থের নিগড়ে বাঁধা নয়, সেখানে রচিত হয় একটা মায়া। যে মায়া ফাল্গুন মাসের দক্ষিণ হাওয়ায়, যে মায়া শরৎ ঋতুতে সূর্যাস্তকালের মেঘপুঞ্জে। মনকে রাঙিয়ে তোলে; এমন কোন কথা বলে না যাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব"। কবিতার এর চেয়ে উৎকৃষ্ট আর আধুনিকতর ব্যাখ্যা কি সত্যিই হতে পারে? রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর উত্তরকালীন সাহিত্য প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের মন্তব্য এক্ষেত্রে স্মর্তব্য- "তাঁর এই অসীম সাম্রাজ্যের অনেক জমি জোতদারের দখলে এসেছে; এবং তাদের মধ্যে যারা পরিশ্রমী, তারা নিজের নিজের এলাকার ফসলের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। ফসলের জাত বদলাতে পারেনি"। আর সেই কারণেই ১৬২ বছর পার করেও হয়ত রবীন্দ্রনাথকে পেরিয়ে যেতে পারিনি আমরা। একবিংশ শতকের সতত পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটেও নক্ষত্রের মত ধ্রুব হয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ, আমাদের প্রাণের ঠাকুর হয়ে। যে আকাশের নীচে আমাদের প্রাত্যহিক ইঁদুরদৌড়, সেই আকাশের সমস্ত তারায় যে একটিমাত্র সুর বাজে, সেই একতারার বাদক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 

Comments

Popular posts from this blog

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

দেবীপক্ষে; দেবীর পক্ষে