বাস করিনি কোথাও


শাস্ত্রকারেরা যতই দেবভাষায় স্বর্গ কাঁপিয়ে হুঙ্কার করুন যে, এ জীবন কিছুই নয়, ক্ষণকালের মায়ামাত্র— তারা নিজেরাও একথা ভালই বুঝতেন যে, এই মায়ার ছায়ার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। আর সেই ছায়ায় বসবাস করতে যা কিছু, যত কিছু প্রয়োজন হয়— তার আয়োজন করতেই এ জীবনের নাভিশ্বাস উঠে যেতে পারে কুলকুণ্ডলীনী ছেড়ে একেবারে সহস্রারে।  এই অসীম প্রয়োজনের তালিকার একেবারে গোড়ার দিকের তিনটি জিনিস— অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান। প্রথম দুটোর দায়িত্ব নেওয়া বা অন্যের ওপরে শাস্ত্রমতে চাপিয়ে দেবার সামাজিক বিধান হয়ত রয়েছে কিন্তু গোল বাধে তৃতীয়টিকে নিয়েই। 


জন্মসূত্রে বা বলা ভালো উত্তরাধিকার সূত্রে যারা বাসস্থানটি অন্ন-বস্ত্রের সঙ্গে মুফতে পেয়ে যান,  তারা স্বভাবতই যাপনের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এই বস্তুটির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন না। আর যাদের ভাগ্যে ভিক্ষের দানে অচল পয়সা, অর্থাৎ যারা পুরুষানুক্রমে বাস্তুহারা, তাদের কাছে দুঃখের, গ্লানির, যন্ত্রণার চক্রবৃদ্ধি সুদে তার আসল দাম বেড়ে হয় অমূল্যের সামিল। সেসব মানুষের আজীবনের অপ্রাপ্তি হতাশার পৌনঃপুনিকে জারিত হয়ে জন্ম নেয় নানা বিকৃত ভাবনা। জন্মের পর থেকে যে শিশুটি আলাদা আলাদা বাড়ির আলাদা আলাদা ঘরে শৈশব, কৈশোর, আর যৌবন পার করল, স্মৃতির স্মরণিতে পিছু ফিরে তাকিয়ে সে কখনই দেখতে পাবে না তার আবাল্য জীবনের একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র। বারবার শিকড় কাটা পড়ার যন্ত্রণা তাকে কুরে-কুরে খাবে আজীবন। এই একই যন্ত্রণার শরিক সারা পৃথিবীর অগণ্য শিকড়হীন মানুষ। 


যেসব মানুষ একই ছাদের নিচে ছোট থেকে বড় এবং বড় থেকে বুড়ো হতে পারার সৌভাগ্যের অধিকারী, তাদের পক্ষে এই যন্ত্রণায় সমব্যথী হওয়া নিতান্ত দুঃসাধ্য। তাদের ছেলেবেলা বা কৈশোরের স্মৃতির ভিতটা শেকড়হীন মানুষের তুলনায় অনেক বেশি জোরালো, মজবুত। কালক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই স্মৃতি ধূসর হয় নিরাপত্তার আবহে আর অন্যপক্ষে সময়ের সঙ্গে সেই স্মৃতি আরও দগদগে বিষাক্ত হয়ে ওঠে নিরাপত্তাহীনতার অবহেলায়, আশঙ্কায়। 


পৈত্রিক বাড়ির মধ্যে ছোটবেলার ঘর গুছিয়ে না রাখলেও থাকে, কিন্তু শিকড়হীন মানুষটার পথ চলতে চলতে হঠাৎ কোন অচেনা-চেনা বাড়ির সামনে এসে পা দুটো থমকে যায়। সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় এমন অনেক কিছু, যা খোলা চোখে দেখার উপায় তার আর নেই। চোখ বুঁজে সে দেখতে পায় সেই বাড়ির কোন একটা ঘরের কোন একটা কোণে দেওয়ালের ফোঁকরে লুকিয়ে রাখা তার একটা খেলনা। সে বাড়ির বাস যখন তার ফুরিয়ে গেল, হয়তো তাড়াহুড়োয় বা অন্য কোন কারণে সেটা তার সঙ্গে নেওয়া হয়নি। যা একদিন একান্তই তার ছিল আজ তার মালিকানা বা অস্তিত্ব সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। এভাবেই যাপন রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে বারবার অঙ্গহানির ফলে। তার ঘর তাকে আশ্রয় দিতে পারে না আর।


আশ্রহীনতার দুঃখের একটা বিরাট পরিসর আছে, সমস্ত পৃথিবীতেই সেই দুঃখের শরিক খুঁজে পাওয়া যায়। রাজনৈতিক মানচিত্রে দেশ যতবার ভাগ হয়েছে, তার ভাগফলে কাটা পড়েছে মানুষ আর ভাগশেষে পড়ে থেকেছে রক্ত কান্না চিৎকার। রাজনৈতিক অভিবাসনের নামে যাদের ঠিকানা বদলে গিয়েছে রাষ্ট্রীয় বাঁটোয়ারায়, সেই সমস্ত মানুষের কাছেই ঘর আর বাসা শব্দদুটো ভীষণ আলাদা হয়ে গিয়েছে।


ঘটি বাঙালির সরস কাজিয়ায় বাড়ি ও বাসার লড়াই রসিক মানুষ মাত্রই জানেন। সেটুকুকে বাদ দিয়ে যদি খোঁজার চেষ্টা করা যায় এই বাড়ি আর বাসার তফাৎটুকু, খুব অল্প আয়াসেই তা খুঁজে পাওয়া যাবে সম্ভবত। ১৯৪৭ আর ১৯৭১ এর অভিবাসনে যে অগণ্য মানুষ নির্মীয়মান সীমান্ত পেরিয়ে সরকারি ফরমানে তাড়া খাওয়া জন্তুর পালের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাত্রা করেছিলেন, তাদের সেই চলে যাওয়ায় মিশে ছিল ফিরে আসতে পারার অন্ধ বিশ্বাস। যদিও তারা ফিরে আসতে বা যেতে পারেননি আর কখনই। "যেখানে ছিল শহর সেখানে ছড়িয়ে রইল কাঠ কয়লা" নেরুদা বর্ণিত সেই বাস্তবতায় অপেক্ষমাণ মেয়েটির মত পড়ে রইল শূন্য বাড়ি, প্রদীপহীন তুলসীমঞ্চ আর ফিরে আসতে পারার আকাশকুসুম কল্পনা। 


সন্ধ্যেবেলা নারকেল গাছে ডাব পাড়তে ওঠা একটা মানুষ বাড়ির অদূরে বিপদের আভাস পেয়ে তাড়াহুড়োতে হাতের অস্ত্রটা গাছেই গেঁথে নেমে এসে দেশত্যাগ করেছিলেন এক কাপড়ে। তিনি আর ফিরে যেতে পারেননি তার দেশে, সেই গাছটার কাছে। মৃত্যুর ঘোরে বিকারগ্রস্ত সেই মানুষটি মৃত্যুর ঠিক পূর্বমুহূর্তে তাই বলে ওঠেন, "দা টা খুলে নাও গাছটা মরে যাবে"। যে আশঙ্কা তাকে তার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তেও অস্থির করে তোলে তা আসলে তার স্মৃতির মৃত্যু। যে স্মৃতি আঁকড়ে ধরে যাবজ্জীবন তিনি বাড়ি ও বাসার পার্থক্য খুঁজলেন, বুঝলেন ও বোঝালেন।


প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে নারী বর্ণাশ্রমের বাইরে অবস্থান করেন বা বলা যেতে পারে, নারী হচ্ছেন পঞ্চম বর্ণ। সামাজিক বিধান অনুসারে এ কথার অর্থ, সমাজে নারীর অবস্থান শূদ্রেরও অধম। যেহেতু সম্পত্তি ও সামাজিক অবস্থানের সম্পর্ক সমানুপাতিক, হয়তো সেই কারণেই শাস্ত্রীয় বিধানে নারীর সম্পত্তির কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না বরং তাকেই বর্ণনা করা হয় ক্রমান্বয়ে পিতা, স্বামী ও পুত্রের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে। লিঙ্গ বৈষম্যের মোড়কে নারীর এই সামাজিক অবমাননার দিকটি ঢাকা পড়ে যায়। সেই মলাটটিকে খুলে দেখলেই দেখতে পাওয়া যাবে এখানেও সেই একই শিকড়হীনতার যন্ত্রণা লুকিয়ে রয়েছে। তার অন্নবস্ত্রের দায়িত্ব নেন ক্রমান্বয়ে এক-একটি পুরুষ, কিন্তু নারীর সেই প্রাপ্তির তালিকার মধ্যে বাসস্থানের উল্লেখ থাকে না। কারণ বাসস্থান একটি স্থাবর সম্পত্তি এবং সেটির ক্ষেত্রে মালিকানার প্রশ্নটি অবশ্যম্ভাবী। তাই বলা যায়, নারীও সেই অর্থে উদ্বাস্তু, শিকড়হীন এবং ত সামাজিক বিধানের নিগড়ে স্বীকৃত।


প্রাচীনকালে, সভ্যতার আদি লগ্নে যাযাবর বৃত্তি যখন ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক একটি ঘটনা, তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা তেমন ছিল না। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীর উত্তরাধুনিক সমাজে যাযাবরবৃত্তি অপরাধের মতো, যেখানে অপরাধীর একমাত্র দোষ তার অপারগতা এবং অসমর্থ হওয়ার অপরাধে তার প্রাণদণ্ড হয় যাবজ্জীবন। আজীবন উৎখাত হতে হতে সে অপেক্ষা করে মৃত্যুর। কারণ একমাত্র মৃত্যুতেই তার যাযাবর জীবনের সমাপ্তি। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের যাবতীয় স্মৃতি থেকে বারবার উৎপাটিত হওয়ার প্রতিশোধ সে নেয় নিজের মৃত্যুতেই। কারণ তার মনে হয়, তার মৃত্যুর পর পৃথিবীর কোন শক্তিই তাকে আর উৎখাত করতে পারবে না তার অন্তিম ঠিকানা থেকে। সেই ঠিকানাতেই অনন্তকাল প্রতিষ্ঠিত থাকবে তার জীবনের, যাপনের যাবতীয় স্মৃতির শেষ মাইল ফলক। হাজার চাইলেও কেউ কখনো সেখান থেকে তাকে উচ্ছেদ করতে পারবে না, এইখানেই তার জিত। 


শিকড়হীনতা তাই শুধু রাজনৈতিক মীমাংসার বিষবৃক্ষের ফল নয়, তার পরিসর অনন্ত। অভিবাসনের পথের কাঁটাতার ক্রমশ সংক্রমিত হয় মানুষের মনের, মননের, বোধের অতলেও। ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ক্রমাগত রক্তক্ষরণে সে শুষে নেয় ছিন্নমূল মানুষগুলোর সমস্ত প্রাণশক্তি। উচ্ছেদ আর বিচ্ছেদের নিরন্তর ষড়যন্ত্রে মরে যেতে যেতে তারা সবাই এক সুর, এক স্বরে কেঁদে ওঠে, 'ঘর ছিল অনেক আমার বাস করিনি কোথাও'। 

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত