রবি-কে যাবে না পাওয়া, 'কবি'র চরিতে
ছিন্নপত্রের একেবারে শুরুতে রবীন্দ্রনাথের যে লেখা ভূমিকারূপে সংযুক্ত এবং প্রকাশিত, তাতে তিনি লিখছেন— "যখন মনে জানি আমার পাঠকেরা আমাকে ভালো করে জানে না, আমার অনেক কথাই তারা ঠিকটি বুঝবে না এবং নম্রভাবে বোঝার চেষ্টাও করবে না, এবং যেটুকু তাদের নিজের মানসিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে না সেটুকু আমার ওপরে বিশ্বাস স্থাপন করে গ্রহণ করবে না— তখন মনের ভাবগুলি তেমন সহজে ভাষায় প্রবাহিত হতে চায় না এবং যতটুকু প্রকাশ হয় তার মধ্যে অনেকখানি ছদ্মবেশ থেকে যায়। এর থেকেই বেশ বুঝতে পারি, আমাদের সবচেয়ে যা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সে আমরা কাউকে নিজের ইচ্ছা-অনুসারে দিতে পারি নে। আমাদের ভিতরে সব চেয়ে যা গভীরতম উচ্চতম অন্তরতম সে আমাদের আয়ত্তের অতীত; তা আমাদের দান-বিক্রয়ের ক্ষমতা নেই.….।" রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে সাহিত্যের ছদ্মবেশের আড়ালে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ তার পাঠকের কাছে বহুলাংশেই অধরা। তার জন্মের ১৬১ বছর এবং মৃত্যুর ৮১ বছর পরেও তাকে নিয়ে গবেষণা আলোচনা বিশ্লেষণ শেষ হয়নি সারা বিশ্বের। তবু যদি প্রশ্ন আসে এত আলোচনা পর্যালোচনার শেষে আদপে কতটুকু চিনেছি তাকে? ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কতটুকুই বা পরিচয় আমাদের? তার পূজার ছলে কি শেষটায় তাকেই ভুলতে বসেছি আমরা? প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও মনের গভীরে কারও অজানা নেই আর।
রবীন্দ্রনাথ বলতে গীতবিতান ইত্যাদির পরেই যা মনে পড়ে তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া বাংলা দিনপঞ্জিকার দুটি তারিখ— ২৫ বৈশাখ ও ২২ শ্রাবণ। কোন কোন আধুনিকতর ব্যক্তি অবশ্য এ প্রশ্নও ছুঁড়ে দেন— "২৫ বৈশাখ কত তারিখ?" এত অবক্ষয় স্বত্বেও রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন আমাদের মনের শেকড়ে। তাই তার মৃত্যুর ৮১ বছর পরেও তিনি আমাদের জীবনে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপনের স্বার্থেই হোক বা সরকারি অনুপ্রেরণায় রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে এখনও আমাদের যাপন অসম্পূর্ণ। ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর যখন তিনি "দেবেন ঠাকুরের ব্যাটা" খেতাব ছেড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামে পরিচিতি পেলেন, সেই থেকে আজ অবধি তিনি আমাদের জীবনে-যাপনে এমন একটি মানুষ, যার ওপরে আকন্ঠ ভরসা করা যায়। রবীন্দ্রনাথ মানেই একটা 'ভাল'র সার্টিফিকেট। একটা নিরাপদ আস্তানা। বাড়ীর বড়োরা গান গাইতে বললে গানের খাতা হাতড়ে রবীন্দ্রনাথের গান খুঁজে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কয়েকবছর আগেও বিবাহ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বই উপহার দেবার চল ছিল, তখনও বই বাছাই-এর ক্ষেত্রে ত্রাহি মধুসূদন সেই রবীন্দ্রনাথ-ই। বিবাহের প্রসঙ্গে মনে পড়ে—রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সহকারী অনিল চন্দ এবং রানী চন্দের বিবাহের কথা। দুই পরিবারের অমত স্বত্বেও এই বিবাহ দেন রবীন্দ্রনাথ নিজে পৌরোহিত্য করে। পারিবারিক অমত অগ্রাহ্য করে যখন এই যুগল রবীন্দ্রনাথের কাছে আশ্রয় নেয়, তখন তিনি নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ নন, তিনি একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক যার ওপরে ন্যস্ত এক প্রণয়ীযুগলের ভবিষ্যত নির্ধারণের গুরুদায়িত্ব। তিনি রবীন্দ্রনাথ বলেই যে তিনি যথেচ্ছাচার করতে পারেন না, তা তার অজানা ছিল না। একাধারে দুই পরিবারের অমত উপরন্তু বিবাহের পৌরহিত্যের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এই দুটিই তিনি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন। রানী চন্দ তার 'গুরুদেব' বইটিতে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন— "আজ বুঝতে পারি এ নিয়ে কতখানি ভাবতে হয়েছিল গুরুদেবকে। আমরা তো অবুঝের মত কাজ করে বসে আছি; ভালোমন্দের কত দায়িত্ব পড়েছিল সেদিন তাঁর উপরে। কিছু মনেই জাগে নি সেসব তখন। পরম নিশ্চিন্ত নিরাপদ মনে হয়েছে নিজেকে।"। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নির্ভরতা ও নির্ভরশীল মানুষের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর।
রবীন্দ্রনাথের নিজের কথা অনুযায়ী, তার মানুষী স্বত্বাকে অনেক বেশি করে তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন তার চিঠিতে। কুলচ্যুত ব্রাহ্মণ কুশারী বংশের পদবি বদলে যায় কলকাতায় এসে। কুশারী-রা ঠাকুর (ঠাকুরমশাই-এর অপভ্রংশে) নামে পরিচিত হন দেশীয় মানুষ ও ইংরেজ বণিকদের কাছে। সেই ঠাকুর পরিবারের সোনার তরী-র শ্রেষ্ঠতম ফসল রবীন্দ্রনাথ স্বীয় প্রতিভায় সেই ঠাকুর পদবিতে জুড়ে নিয়েছেন এক দৈব ব্যঞ্জনা। ঠাকুর যেন তার ক্ষেত্রে পদবি নয়, হয়েছে বিশেষণ। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ; ঠাকুর বলেই তার মানুষী স্বত্বা থাকতে নেই। ঈশ্বরের আবার যন্ত্রণা কিসের! অমৃতস্য পুত্র ইমেজের আড়ালে তাই জীবন যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট মানুষটি নিভৃতবাস করেছেন। সেই মানুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদের সকলের মতই ভীষণ পার্থিব, রক্তমাংসের। তার অসুখ হয়, আনন্দ হয়, দুঃখ হয়, কান্না পায়। আবার বিশ্বকবি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ এসবের উর্ধ্বে। তিনি উঠতে না চাইলেও তার ভক্তরা তাকে ভক্তির ঠেলায় পার্থিব বন্ধন মুক্ত করে সত্য অর্থেই আকাশচারী ঠাকুর বানিয়ে ফেলেছেন। সেই হুজুগে যেন অন্ত্যমিলে একাকার হয়ে গেছেন রবিঠাকুর আর দুগ্গাঠাকুর। শাঁওলী মিত্র তার 'আমার রবীন্দ্রনাথ' নিবন্ধে লিখছেন— "তাঁকে আরো একটু বেশি জানা যে অত্যন্ত জরুরি সেই বোধটি আমাদের সমাজ থেকে সুকৌশলে উধাও করে দেওয়া হয়েছে। তবু মানুষটিকে বিদেয় করে দেওয়া যায়নি বলেই তাঁর প্রতি অদম্য আকর্ষণ 'হুজুগ' -এর রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে…”।
রবীন্দ্রনাথ কখন যেন মানুষ থেকে পণ্য হয়ে গিয়েছেন সকলের অজান্তে। অথবা হয়ত আমরা দেখেও চোখ বুঁজে ছিলাম। বিশ্বায়নের বাজারে রবীন্দ্রনাথ এমন একটি প্রোডাক্ট যার সবটুকুই ভাল, সবকিছুই ব্যবহার্য। অর্থাৎ তার গান, কবিতা থেকে শুরু করে কেচ্ছা (কাল্পনিক?) সবকিছুই "লোকে খায়"। বিস্মৃতির জাতীয় ঐতিহ্যে ক্রমেই আবছা হয়ে আসছেন মানুষ রবীন্দ্রনাথ। যিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষকদের মাইনে দিতে না পেরে অধোমুখে আকাশ-পাতাল ভাবছেন, যিনি নোবেল পুরষ্কারের টাকা দিয়ে আশ্রমের নর্দমা সংস্কার করছেন। যিনি দুঃখ, অপমান, মৃত্যুশোকে জর্জরিত হয়েও অটল সংকল্পে দাঁড়িয়ে থাকছেন বটগাছের মতই। রবীন্দ্রনাথের সন্তানদের মধ্যে এক রথীন্দ্রনাথ বাদে সকলেই মারা যায় তার জীবদ্দশাতেই। রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর পদবি অথবা বিশেষণটাকে একবার বাদ দিয়ে যদি পাঠক প্রতিবেশীর জানলার মত করে আড়ি পাতেন তার জীবনে, তিনি দেখবেন রবীন্দ্রনাথ ঠিক আমাদেরই মত একজন মানুষ। দুঃখে যন্ত্রণায় কাতর হয়েও পরিবারে পিতা যেমন হাসিমুখে ভরসা যোগান সকলকে, তেমনই রবীন্দ্রনাথও বিষম ঝড়ের বায়ে পাড়ি দিয়েছেন মারের সাগর। আমরা তো জানতে পারিনি বা হয়ত জানতে চাইনি। ১৮৮৭ সালে দার্জিলিং থেকে তিনি ইন্দিরা দেবীকে যখন তার কোমর ভাঙার সংবাদ দিয়ে লেখেন— "আমার কোমর আমারই কোমর, বেচি নি তো তাহা কাহারও কাছে! ভাঙাচোরা হোক, যা হোক, তা হোক, আমার কোমর আমারই আছে!"— এ লেখা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নয়, ইনি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এ কথা লিখলে তা ভক্তের দলের হজম হত না কিছুতেই। এভাবেই পাঠকের হজমের দুর্বলতায় মানুষ রবীন্দ্রনাথের যাপন ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু-র লেখনী স্মর্তব্য— " একজন অমৃতপুত্রকে আমরা তখনই আবার সহজভাবে তাঁর মর্ত্যরূপে ভাবতে পারি, যখন সময়ের ব্যবধানে অনেক অবান্তর সঞ্চয় ঝরে পড়ে, আবার সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হবারও বাধা থাকে না…"। অতঃপর প্রশ্ন আসে সেই সময় কি এখনও আসেনি। রবীন্দ্রনাথের জীবনের বয়স দেড়শো পেরিয়েছে, মৃত্যুর বয়সও মরণকালে ঠেকেছে। এখনও কি সব অবান্তর সঞ্চয় ঝরে পড়ার সময় হয়নি? অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে আরও কতদিন চোখ বুঁজে থাকব আমরা? আরও কতদিন?
Comments
Post a Comment