অকাল-বোধনের প্রথম সকাল
দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে বাঙালির যাপনের সঙ্গে সবচেয়ে সম্পৃক্ত যে উৎসব, তা দুর্গাপূজা। এতে শুধু এবং শুধুমাত্র বাঙালিরই একচেটিয়া অধিকার। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'জাতিস্মর' ছায়াছবির শেষাংশেও দেখা যায় কুলপতি নিদান দিচ্ছেন, দুর্গাপূজা বাঙালির উৎসব, অবাঙালি 'ম্লেচ্ছ'র তাতে অধিকার নেই। সমাজপতির নির্দেশে তাই 'যথেচ্ছাচার'-এ প্রাণ দিতে হয় অ্যান্টনি কবিয়ালের স্ত্রী সৌদামিনী-কে। অতঃপর প্রশ্ন আসে, নদী থুড়ি দুর্গাপূজা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী-তে। ভারত-ভাগ (১৯৪৭) হতে তখনও ৩৬৫ বছর বাকি আর বাংলাদেশের জন্মলগ্ন (১৯৭১) আসতে বাকি আরও ২৪ বছর। তখন এ-পার আর ওপারের মধ্যে কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই ছিল, পাসপোর্ট-ভিসা নবতর সংযোজন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে সৃষ্টির আদিতে কৃষ্ণ বৈকুন্ঠের মহারাসমন্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ অসুরের ভয়ে দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন প্রজাপতি ব্রহ্মা, তৃতীয়বারে ত্রিপুর অসুর দমনের কালে দেবী পূজিতা হন শূলপাণি শিবের দ্বারা, চতুর্থবার দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষীকে হারিয়ে ইন্দ্র দেবীর পূজা করেন। দেবীভাগবতপুরাণ অনুযায়ী, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গামূর্তি তৈরি করে তার পূজা করেন।
সুরলোক ছেড়ে এবারে নেমে আসা যাক মর্ত্যলোকে। সুলতান শাসিত বাংলার বারো ভূইয়ার কথা প্রায় সর্বজনবিদিত। এই বারো ভূইয়ার মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনবান তথা প্রভাবশালী ছিলেন রাজশাহী তাহেরপুরের শাসক গৌড়েশ্বর রাজা কংসনারায়ণ রায়। তিনি ভট্টনারায়ণ রায়ের পুত্র উদয়নারায়ণ রায়ের পৌত্র। জমি জরিপের কাজে টোডরমল এবং মুঘল সম্রাট আকবরের সহায়তা করে তিনি 'রাজা' উপাধি লাভ করেন। যদিও সাহায্যের পরিবর্তে বাংলার শাসনভার প্রত্যাশিত ছিল, কিন্তু বিধি বাম, পেলেন কেবল রাজা উপাধি, সত্যি-সত্যি রাজা হওয়া হল না তার। মনে করা যেতে পারে সেই দুঃখমোচন করতেই তিনি রাজসূয় মহাযজ্ঞ করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। ডাক পড়ে রাজশাহীর সমস্ত বেদজ্ঞ পন্ডিতদের। তৎকালীন সময়ে রাজশাহীর ব্রাহ্মণকুলের মাথা আচার্য রমেশ শাস্ত্রীও আমন্ত্রিত হন। রাজার মনোবাসনা জানতে পেরে পন্ডিতেরা বিধান দেন চারপ্রকার মহাযজ্ঞ অর্থাৎ— বিশ্বজিৎ, রাজসূয়, অশ্বমেধ ও গোমেধ-এর মধ্যে প্রথম দু-প্রকারের অধিকার কেবল সার্বভৌম সম্রাটের, ফলে কংসনারায়ণের তাতে অধিকার নেই এবং পরবর্তী দু-প্রকার অর্থাৎ অশ্বমেধ ও গোমেধ কলিযুগে নিষিদ্ধ। অতঃপর রমেশ শাস্ত্রী বিধান দেন, মার্কন্ডেয় পুরাণ অনুসারে দুর্গাপূজাই কলিযুগে একমাত্র সম্ভাব্য মহাযজ্ঞ এবং এটি পূর্বোক্ত চারটি মহাযজ্ঞের সমান ফলদায়ী। এরপর তৎকালীন সময়ে প্রায় ন-লক্ষ (মতান্তরে আট লক্ষ) টাকা খরচ করে ১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহীতে স্ব-প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে দুর্গাপূজা করেন কংসনারায়ণ। রমেশ শাস্ত্রীর মতে দুর্গাপূজা শাস্ত্রবিহিত হলেও দেবভাষায় অজ্ঞ সাধারণ প্রজার পক্ষে তা বোধগম্য না-ও হতে পারে এবং যে উদ্দেশ্যে কংসনারায়ণ এই পূজা করলেন, অর্থাৎ রাজমাহাত্ম্য প্রচার, সেটিকে সাধারণ প্রজার কাছে স্পষ্টতর করে ফুটিয়ে তুলতে এক অনবদ্য কৌশল আশ্রয় করলেন কংসনারায়ণ। রাজপন্ডিতের পদ-অভিলাষী কৃত্তিবাস যখন এসে পৌঁছলেন গৌড়েশ্বর কংসনারায়ণ রায়ের দরবারে, তখন কংসনারায়ণ তাকে আদেশ করেন রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করার। পাঁচালিছন্দে রচিত এই অনুবাদে কংসনারায়ণের নির্দেশে এবং স্বীয় প্রতিভায় কৃত্তিবাস অকাল-বোধন পর্বের যোজনা করেন। বাল্মিকী-প্রণীত সংস্কৃত রামায়ণ অথবা রামায়ণের অন্য কোন অনুবাদেই অকাল-বোধনের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না। রামায়ণ অনুসারে রাম ছিলেন সার্বভৌম রাজা এবং লোকবিশ্বাসে সর্বগুণসম্পন্ন রাজাকে 'রামের মত রাজা' অভিধায় অভিহিত করা যায়। অতএব রামায়ণের অনুবাদে অকাল-বোধন পর্বের সংযোজন এবং তার অব্যবহিত পরেই কংসনারায়ণ কর্তৃক দুর্গাপূজার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হল যে কংসনারায়ণের রাজত্বই বস্তুত রামরাজত্ব এবং তিনি রামের মতই সার্বভৌম রাজা।
কংসনারায়ণ-কৃত দুর্গাপূজা ইতিহাসে সর্বজনস্বীকৃত হলেও কয়েকটি বিষয় নিয়ে মতান্তর রয়েছে। কংসনারায়ণ কেন দুর্গাপূজা করেছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও মতে কংসনারায়ণের পরিবার পশুবলির বিরোধী ছিলেন বলেই তিনি অশ্বমেধ ও গোমেধ যজ্ঞের পরিবর্তে দুর্গাপূজার বিকল্প বেছে নেন। এই যুক্তিকে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না কারণ বলি দুর্গাপূজাতেও হয়। অতএব পশুবলি বিরোধী হওয়ার কারণে কংসনারায়ণ অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ করেননি, এ ভাবনা বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত, বাংলার বুকে কালাপাহাড়ের অত্যাচার নিয়ে ক্ষুব্ধ কংসনারায়ণের সঙ্গে সুলতানের মতবিরোধ হলে তিনি সুবাদার পদ ত্যাগ করেন এবং মুঘল সহায়তায় সুলতানি শাসনের উচ্ছেদে সহায়তা করেন। একটি মত অনুসারে এই গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে না কি তিনি দুর্গাপূজা করেন। এ মন্তব্যটিও বিশ্বাসযোগ্য নয়, কেননা গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে রাজসূয় যজ্ঞের বা ন-লাখ টাকা খরচের প্রয়োজন হয় না। কংসনারায়ণ তার নিজের রাজ-মহিমা ও অর্থ-প্রতিপত্তি প্রচার করতেই দুর্গাপূজা করেন এই যুক্তিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তৃতীয়ত, অপর একটি মত অনুসারে রাজা আদিশূর বঙ্গদেশে বেদবিহিত শাস্ত্রাচার প্রচলনের জন্য কান্যকুব্জ থেকে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণকে এ দেশে নিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে একজন সুধানিধির বংশকে ঘোষাল উপাধি দেন লক্ষণসেন। আকবরের আমলে এরা জমিদারি লাভ করেন। এই বংশের আশুতোষ ঘোষাল ১৪৫৪ সালে কোন্নগরে স্বগৃহে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরের কাছে মালঞ্চ গ্রামের জনৈক চামু বাগচী/ব্রহ্মচারী ১৪৯১ সালে বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণমতে দুর্গাপূজা করেন। এরপর ১৫০৭ সালে চন্দননগরের বসু বাড়ীতে করুণাময় বসু দুর্গাপূজা করেন, তারপর হাওড়া আমতার রসপুরে যশচন্দ্র রায়ের বাড়ীতে দুর্গাপূজা হয় ১৫৩০ সালে। এরপরে ১৫৮২ (মতান্তরে ১৫৮০) সালে কংসনারায়ণ রায় দুর্গাপূজা করেন। এই সারণির প্রথম নামটি অর্থাৎ সুধানিধির বংশধর আশুতোষ ঘোষাল-কে ঐতিহাসিক প্রমাণে কংসনারায়ণের চেয়ে প্রাচীন বলে দাবি করা যায় না কারণ পূর্বোক্ত পাঁচজন ব্রাহ্মণের একজন অর্থাৎ ভট্টনারায়ণের প্রপৌত্র ছিলেন কংসনারায়ণ রায়। এ ছাড়া উপরিউক্ত সারণির পূজাগুলির ইতিহাস যথেষ্ট প্রামাণ্য নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্রীচৈতন্যদেব-এর অনুচর নিত্যানন্দ না কি খড়দহে একবার দুর্গাপূজা করেন, কিন্তু এ ঘটনার সমর্থনে যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকায় ঘটনাটিকে স্বীকার করা সম্ভব নয়। অন্তিমে একটি বিষয় অনস্বীকার্য, কংসনারায়ণের আগে যদি বাংলায় দুর্গাপূজা হয়েও থাকে, তা মার্কন্ডেয় পুরাণে বর্ণিত মহাযজ্ঞের আকারে হয়নি। অর্থাৎ বর্তমানকালে দুর্গাপূজার প্রচলিত যে বিপুল আয়োজন এবং শাস্ত্রীয় পদ্ধতি, তার সূচনা হয়েছিল কংসনারায়ণের হাত ধরেই এবং তা হয়েছিল আজকের রাজনীতি-বিভক্ত বাংলাদেশে।
Comments
Post a Comment