Posts

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

হৈম ন্তী গল্পে রবীন্দ্রনাথ কথকের মুখে বলেছিলেন, “দানের মন্ত্রে স্ত্রী-কে যেটুকু পাওয়া যায়, তাহাতে সংসার চলে কিন্তু পনেরো আনা বাকি থেকে যায়”। গল্পকার এই পর্যন্ত বলেই শেষ করেছিলেন এ প্রসঙ্গ, এর চেয়ে ফেনিয়ে বলতে হয়ত তাঁর রুচিতে বেধেছিল, অথবা তিনি ভরসা করেছিলেন, স্বজাতির ওপর, তাদের বোধের ওপর৷ তাঁর এই ভরসা যে কতখানি ভিত্তিহীন ছিল, তা যখন তিনি বুঝেছিলেন, তখন অনেকখানি দেরি হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুর পদবীর জোরে(?) যখন মানুষ রবীন্দ্রনাথ দেবতা হয়ে উঠলেন, তখন আর কিছুতেই তাঁর মানুষ হবার উপায় রইল না। তিনি নিজেই লিখেছিলেন, “ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে, অন্ধ সেজন মারে আর শুধু মরে”— এই লেখা তাঁর নিজের ক্ষেত্রেই এতখানি সার্থক হয়ে উঠবে জানলে হয়ত একটা প্রতিকারের বা অন্তত পালানোর পথ ভেবে রাখতেন। নজরুল নিজেকে “হুজুগের কবি” বলে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিলেন, সেরকমই কোন কাব্যিক উপায় হয়ত রবীন্দ্রনাথও জোটাতেন। না হলে “দেখলে গতিক মন্দ” ডুবতেন অগাধ জলে, তেমনি করেই কাটিয়ে দিতেন, “লুকোচুরির ছলে”৷ রবীন্দ্রনাথের মানুষী অস্তিত্বের বিলোপসাধনের সঙ্গে সঙ্গে যে বিষয়টি মারক হয়ে ওঠে, তা হল তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টির ভুল তথা অক্ষম অনুবাদ। রব

দেবীপক্ষে; দেবীর পক্ষে

শাক্ত কবি যখন আবেগতাড়িত হয়ে হিমালয়-জায়ার বয়ানে লিখলেন, "এবার আমার উপায় এলে আর উমা পাঠাব না"— মনের গভীরে তিনি জানতেন এ কেবলই কথার কথা। বাস্তবে, সামাজিক চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে উমার পিতৃগৃহে দীর্ঘ প্রবাস সম্ভবপর হবে না কোনমতেই। তাই দেবীপক্ষের শুরুতে যে প্রতিরোধ অলঙ্ঘ্য বলে মনে হয়েছিল, সে প্রতিরোধ দুর্বলতর হতে হতে দিনের শেষে ঘাড় ধাক্কার রূপ পরিগ্রহ করে। "যেও না নবমী নিশি" — মর্মে মেনকা যতই কাঁদাকাটা করুন না কেন, তিনি নিজেও এ কথা জানতেন, যে নবমীর রাত পোহালে যদি তার মেয়ে শ্বশুরবাড়িমুখো না হয়, তবে তার মেয়ের বধ করা সমস্ত অসুর সামাজিকতার অব্যর্থ বরে বেঁচে ওঠে তার চারপাশে বর্বর নৃত্য আরম্ভ করবে এবং তার মেয়ে দশ হাতেও সমাজের পাঁচ কান বন্ধ করতে পারবে না। বোধনের বাজনার গভীরে যে বিসর্জনের প্রস্তুতি চলে, এই রূঢ় সত্যকেই কোমলতার কিংখাবে ঢাকতেই এত কথা, এত গান, এত গল্প আর এত আয়োজন। এত মলাটের প্রয়োজন এই কারণেই। দিনশেষের গলা ধাক্কায় মেয়ের ঘাড় ভেঙে যায় যাক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার হৃদয় যেন অক্ষত থাকে। ভগ্নহৃদয়ে সে শ্বশুরবাড়ী গেলে সেখানে বাপের বাড়ীর নিন্দে হবে। এই দ্বি-চা

বাস করিনি কোথাও

শাস্ত্রকারেরা যতই দেবভাষায় স্বর্গ কাঁপিয়ে হুঙ্কার করুন যে, এ জীবন কিছুই নয়, ক্ষণকালের মায়ামাত্র— তারা নিজেরাও একথা ভালই বুঝতেন যে, এই মায়ার ছায়ার বাইরে বেরিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ নয়। আর সেই ছায়ায় বসবাস করতে যা কিছু, যত কিছু প্রয়োজন হয়— তার আয়োজন করতেই এ জীবনের নাভিশ্বাস উঠে যেতে পারে কুলকুণ্ডলীনী ছেড়ে একেবারে সহস্রারে।  এই অসীম প্রয়োজনের তালিকার একেবারে গোড়ার দিকের তিনটি জিনিস— অন্ন বস্ত্র ও বাসস্থান। প্রথম দুটোর দায়িত্ব নেওয়া বা অন্যের ওপরে শাস্ত্রমতে চাপিয়ে দেবার সামাজিক বিধান হয়ত রয়েছে কিন্তু গোল বাধে তৃতীয়টিকে নিয়েই।  জন্মসূত্রে বা বলা ভালো উত্তরাধিকার সূত্রে যারা বাসস্থানটি অন্ন-বস্ত্রের সঙ্গে মুফতে পেয়ে যান,  তারা স্বভাবতই যাপনের পক্ষে অতি প্রয়োজনীয় এই বস্তুটির সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন না। আর যাদের ভাগ্যে ভিক্ষের দানে অচল পয়সা, অর্থাৎ যারা পুরুষানুক্রমে বাস্তুহারা, তাদের কাছে দুঃখের, গ্লানির, যন্ত্রণার চক্রবৃদ্ধি সুদে তার আসল দাম বেড়ে হয় অমূল্যের সামিল। সেসব মানুষের আজীবনের অপ্রাপ্তি হতাশার পৌনঃপুনিকে জারিত হয়ে জন্ম নেয় নানা বিকৃত ভাবনা। জন্মের পর থেকে

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

Image
  দমদম বিমানবন্দর। জাতিগত ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করে নির্ধারিত সময়ের অনেকটা আগে, মায় যার জোরে আমি উড়ব (না, সে আমার রাজনৈতিক আত্মীয় বা ওই গোছের কেউ নয়) তারও আগে বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। সাইনবোর্ডে কলকাতার এবং তদীয় সংস্কৃতির ঢাক তেরেকেটে তাক তাক দেখতে দেখতে ঢুকে পড়লাম বোর্ডিং পাশ জোগাড়ের লাইনপাশে! সর্পিল উন্নয়ন পেরিয়ে যখন কাউন্টারে আসীন বিপত্তারণের কাছে পৌঁছলাম, দেখি তিনি সংগত কারণেই ভারি ব্যস্ত। তাকে বিব্রত করার চেষ্টা যথাসম্ভব না করে মোলায়েম গলায় কথা বলার চেষ্টা করতেই বুঝলাম, আমার মাতৃভাষার ক্যার্দানি এখানে খাটবে না। রাষ্ট্রভাষায় (যদিও ব্যাপারটা অস্তিত্বহীন) আমার দখল উদ্বাস্তুর সামিল। কাজেই ইংরেজিই ভরসা। ব্যকরণ-কে নেহাত অকারণ জ্ঞানে ছেঁটে ফেলে তিনি আমায় যা বললেন, তা আমার যৎসামান্য বোধে কষ্টেসৃষ্টে কুলিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম বৈকুন্ঠধামের ১০৪ নম্বর দরজা আমার জন্যে বরাদ্দ হয়েছে।  বোর্ডিং কার্ডের বদান্যতায় নিরাপত্তা বলয় পার করে যখন অপেক্ষার পালা এল, প্রকৃতির ডাকে অল্পেকটু সাড়া দিয়ে একটু হাঁফ ছাড়তে পারলাম। এবার অপেক্ষার পালা, কারণ এখনও আমার সময় হয়নি। আর এই কথা আমি ছাড়াও অনেকে জানে সম্ভবত। তাই চাঁ

কবিতার অনুবাদ: কবির যাপনান্তর

ক বিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— "a poem cannot be translated, it can only be re-lived in a different atmosphere"। এই মন্তব্যকে যদি সত্যি বলে মেনে নিই আর সেইসঙ্গে কবি ও কবিতার যদি একটি অভেদ কল্পনা করি তাহলে যে প্রশ্নটি অনিবার্য হয়ে ওঠে তা হল, কবিতার অনুবাদ যদি অসম্ভব হয়, তার সময়োচিত সংস্কারের একমাত্র পথ যদি হয় তার যাপনান্তর, তাহলে কবির ক্ষেত্রেও কি সেই একই সূত্র প্রযোজ্য হবে? তাকেও কি সময়ের বা দেশকালের ব্যবধানে সংস্কার করে নিতে হবে প্রাসঙ্গিকতার মাপকাঠিতে? কবিতার অন্তরে কবির যতটুকু যাপন বন্দী হয়ে থাকে, সেই যাপনেরই শরিক হয়ে ওঠেন পাঠক। দেশ-কাল-সময়ের ব্যবধানে কবির সঙ্গে পাঠকের সেখানে যতটুকু ব্যবধান, সেই শূন্যস্থান পূরণেই মধ্যস্থতা করে অনুবাদ। তাই অনুবাদকে বলা চলে কবি ও কবিতার সময়োচিত সংস্কার। অতঃপর প্রশ্ন আসে, সংস্কার আসলে কী? আর কবিতা বা কবির সংস্কার আদপেই কেন প্রয়োজন? জৈমিনি সূত্রে বলা হয়েছে, "সংস্কারো নাম স ভবতি, যস্মিন। জাতে পদার্থ ভবতি যোগ্যঃ কস্যচিদ অর্থস্য।।"। এক্ষেত্রে যে যোগ্যতার প্রশ্নটি উঠে এসেছে তার ব্যাখ্যা শাস্ত্রকার কুমারিল ভট্টের মতে

অকাল-বোধনের প্রথম সকাল

দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে বাঙালির যাপনের সঙ্গে সবচেয়ে সম্পৃক্ত যে উৎসব, তা দুর্গাপূজা। এতে শুধু এবং শুধুমাত্র বাঙালিরই একচেটিয়া অধিকার। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত 'জাতিস্মর' ছায়াছবির শেষাংশেও দেখা যায় কুলপতি নিদান দিচ্ছেন, দুর্গাপূজা বাঙালির উৎসব, অবাঙালি 'ম্লেচ্ছ'র তাতে অধিকার নেই। সমাজপতির নির্দেশে তাই 'যথেচ্ছাচার'-এ প্রাণ দিতে হয় অ্যান্টনি কবিয়ালের স্ত্রী সৌদামিনী-কে। অতঃপর প্রশ্ন আসে, নদী থুড়ি দুর্গাপূজা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী-তে। ভারত-ভাগ (১৯৪৭) হতে তখনও ৩৬৫ বছর বাকি আর বাংলাদেশের জন্মলগ্ন (১৯৭১) আসতে বাকি আরও ২৪ বছর।  তখন এ-পার আর ওপারের মধ্যে কেবল ভৌগোলিক দূরত্বই ছিল, পাসপোর্ট-ভিসা নবতর সংযোজন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুসারে সৃষ্টির আদিতে কৃষ্ণ বৈকুন্ঠের মহারাসমন্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ অসুরের ভয়ে দ্বিতীয়বার দুর্গাপূজা করেন প্রজাপতি ব্রহ্মা, তৃতীয়বারে ত্রিপুর অসুর দমনের কালে দেবী পূজিতা হন শূলপাণি শিবের দ্বারা, চতুর্থবার দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষীকে হারিয়ে ইন্দ্র দেবীর পূজা করেন। দেবীভাগবতপু

রবি-কে যাবে না পাওয়া, 'কবি'র চরিতে

ছিন্নপত্রের একেবারে শুরুতে রবীন্দ্রনাথের যে লেখা ভূমিকারূপে সংযুক্ত এবং প্রকাশিত, তাতে তিনি লিখছেন— "যখন মনে জানি আমার পাঠকেরা আমাকে ভালো করে জানে না, আমার অনেক কথাই তারা ঠিকটি বুঝবে না এবং নম্রভাবে বোঝার চেষ্টাও করবে না, এবং যেটুকু তাদের নিজের মানসিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলবে না সেটুকু আমার ওপরে বিশ্বাস স্থাপন করে গ্রহণ করবে না— তখন মনের ভাবগুলি তেমন সহজে ভাষায় প্রবাহিত হতে চায় না এবং যতটুকু প্রকাশ হয় তার মধ্যে অনেকখানি ছদ্মবেশ থেকে যায়। এর থেকেই বেশ বুঝতে পারি, আমাদের সবচেয়ে যা শ্রেষ্ঠ প্রকাশ সে আমরা কাউকে নিজের ইচ্ছা-অনুসারে দিতে পারি নে। আমাদের ভিতরে সব চেয়ে যা গভীরতম উচ্চতম অন্তরতম সে আমাদের আয়ত্তের অতীত; তা আমাদের দান-বিক্রয়ের ক্ষমতা নেই.….।" রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে সাহিত্যের ছদ্মবেশের আড়ালে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ তার পাঠকের কাছে বহুলাংশেই অধরা। তার জন্মের ১৬১ বছর এবং মৃত্যুর ৮১ বছর পরেও তাকে নিয়ে গবেষণা আলোচনা বিশ্লেষণ শেষ হয়নি সারা বিশ্বের। তবু যদি প্রশ্ন আসে এত আলোচনা পর্যালোচনার শেষে আদপে কতটুকু চিনেছি তাকে? ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কতটুকুই বা