পান; খাওয়া নয়, করা
পান- খাওয়া নয়, করা
অমিতায়ু চক্রবর্তী
চর্ব্য চুষ্য লেহ্য পেয়- এই ফুল কোর্স আহারের পাহাড়ের অন্তিম শিখরটি হল পেয় অর্থাৎ পানীয়, যা না থাকলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে নিদারুণ কষ্ট হয়। আধুনিক বাঙালি সময়ের স্বল্পতায় জল দিয়েই ভোজনকালীন পানের ব্যাপারটা সেরে ফেলতে অভ্যস্ত হলেও নন কর্পোরেট মধ্যযুগে ব্যাপারটি এমন ছিল না। যদিও বিদেশী পর্যটক লিখেছেন যে মূলত ভিক্ষুক শ্রেণীর মধ্যেই এই পানীয় নিয়ে নানারকম ফ্যান্টাসি বা রকমারি পানীয়ের রেসিপি জন্ম ও বিকাশলাভ করেছিল। তবে সে কারণে আধুনিক পানবিলাসীরা হীনমন্যতায় ভুগবেন না। কেননা সোমরস জাতীয় পানীয় যা আজকের উৎকৃষ্টতর WINE, তা সমাজের ওপরতলারই অংশ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে বলেই ভরসা।
পর্যটক লিখছেন, সেকালে অন্তত পাঁচ থেকে ছয় রকম শরবৎ বা পানার উল্লেখ তিনি পেয়েছেন এই বঙ্গদেশে। সেগুলির নাম যথাক্রমে-
১. চোচ পান ২. মোচ পান ৩. কুলক পান ৪. অশ্বত্থ পান ৫. পরুসক পান ৬. খর্জুর পান
নামগুলো উত্তরাধুনিক যুগের পক্ষে অন্যায় রকম খটমট, তাই পাঠকের সুবিধার্থে খোলসা করে বলা প্রয়োজন। খর্জুর পান বলতে খেজুর রস-কে বোঝানো হয়েছে, কুলক পান সম্ভবত কাঁকুড়ের শরবৎ, কুলের পানার পক্ষেও যুক্তি দিয়েছেন কেউ কেউ, মোচ পান কলার পানা বা থোড়ের রস, চোচ পান ডাবের জল এবং পরুসক পান একপ্রকার বন্য দ্রাক্ষা বা আঙুরের রস, আধুনিক ভাষায় কানট্রি স্পিরিট বা লোকাল লিকারও বলা যেতে পারে একে।
এভাবেই সেকালের এলিট গোষ্ঠীর বাইরের প্রান্তিক জন রসে বশে থেকেছে হাজার দারিদ্র্য, লক্ষ দুর্দশাতেও। আধুনিকতার আবহে ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভুলে গিয়েছি আমাদের সেই আনন্দে থাকার গোপন কৌশলটিও। ইতিহাসের স্মৃতিচারণে সেটুকু মনে করাতে পারলেই এই পান-বিলাস সার্থক হবে।
Comments
Post a Comment