বাঙালি- So Fishy

 

বাঙালি; so fishy

অমিতায়ু চক্রবর্তী।

কথায় বলে মাছে-ভাতে বাঙালি। শুধু ‘কথায় বলে’, সেই কারণেই তাকে ফেলনা ভাবলে চরম বোকামি করা হবে। বাঙালি জীবনের সঙ্গে মাছ ও ভাতের সম্পর্ক এমনই প্রগাঢ় যে তাকে বাদ দিয়ে বাঙালি জীবন ও যাপন অসার না হলেও নেহাতই অস্থিচর্মসার। বাঙালি মনন থেকে আঁশটে গন্ধ না পাওয়া গেলে তাকে বড্ড বেমানান মনে হয় যেন। বাঙালি জীবনে ও আহারে মাছের এমন আগ্রাসনের বেশ কয়েকটি কারণ সহজেই অনুমান করা যেতে পারে। প্রথমটি অবশ্যই ভৌগোলিক। বাংলাদেশ (অখন্ড, অধুনা নহে) নদীমাতৃক হবার কারণে সেখানে জল ও জলচর মাছের ওপরে বাঙালি যাপনের নির্ভরশীল হয়ে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এছাড়াও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই দেশ কৃষিনির্ভর হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষকে জীবিকার কারণেই নদীর কাছাকাছি বাস করতে হত। ফলে, মাছের সঙ্গে মোলাকাত না হয়ে তার যায় না। তাই অবিলম্বে জল ছেড়ে জাল ও তার অনতিপরেই থালায় আবির্ভূত হতে সময় লাগেনি তাদের। আর শুধু নদী নয়, পুকুর খাল বিলের সঙ্গে সঙ্গে চাষের খেতে বর্ষার জমা জলেও জন্ম নিত নামগোত্রহীন বহু মাছ, যারা মৎসকূলে কুলীন না হলেও জনপ্রিয় ছিল সাধারণ জীবনে তথা রান্নাঘরে। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ যারা, তারাও রাতারাতি পাঁচটি প্রচলিত ও সুস্বাদু মাছকে নিরামিষ বলে ঘোষণা করে দিলেন পাছে তারা নিরামিষাশী বলে এই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন। তাই, বৃহদ্ধর্মপুরাণের সেই কালজয়ী শ্লোকটি অবশ্য স্মর্তব্য। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘ইলিশো খলিশাশ্চৈব, ভেটকি মদগুর এ বচ/ রোহিতো মৎসরাজেন্দ্র পঞ্চমৎস নিরামিষা’। অর্থাৎ, ইলিশ খলিশ, ভেটকি, মাগুর এবং মাছের রাজা রুই আমিষ নয় বরং নিরামিষ। ফলে এরপরে আমিষ নিরামিষের প্রচলিত ধারণা যেমন মনে মনে খোঁড়া হয়ে যাবে, তেমনি বাঙালির মাছপ্রীতির সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারণা তৈরি করা যাবে। তবে শুধু দেবভাষা নয়, বাংলার একটু প্রাচীন রূপ প্রাকৃত ভাষাতেও মাছের জয়জয়কার। এখানে মাছকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাঙালি মহিলার বৈধব্য ঘটলে শোকজ্ঞাপক চিহ্ন হিসেবে তিনি মাছ খাওয়া ছেড়ে দেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় আমরা, ‘দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা’। তাই, আমাদের এই প্রিয় খাদ্য থেকে বঞ্চিত হননি আমাদের দেবতারাও। তাই বিভিন্ন পুজোয় দেবতাকে উৎসর্গ করা নৈবেদ্য-তে জায়গা করে নিয়েছে এই জলচর প্রাণীগুলি। প্রাকৃতপৈঙ্গলে লেখা হচ্ছে, ‘ওগগর ভত্ত/ রম্ভাঅ পত্ত/ গাইক ঘিত্তা/ দুগ্ধ সজুত্তা/ মোইনী মচ্ছা/ নালিচ গচ্ছা/ দিজ্জই কান্তা/ খাই পুনবন্তা’। অর্থাৎ, কলাপাতায় গরম ভাত, ময়না মাছ, নালিতা শাক সহকারে খেতে দিয়েছেন স্ত্রী এবং পুণ্যবান স্বামী তা আহার করছেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে যখন ঈশ্বরী পাটনি দেবী অন্নদার কাছে তার সন্তানের ‘দুধে-ভাতে’ থাকার আশীর্বাদ কামনা করেন, তখন মনে হয় তিনি চাইলে অনায়াসেই ‘মাছে-ভাতে’ বলতে পারতেন, কেননা সেক্ষেত্রে কন্যাসন্তানের যাতে বৈধব্য না হয়, সেই কামনাও সুপ্ত হয়ে থাকতে পারত। এভাবেই বাঙালি জীবনে মাছ শুধু রসনাতৃপ্তির উপকরণ নয়, বরং তা একটি বিশেষ জাতির সমাজ তথা যাপনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। বাঙালি মননে তাই আগাপাশতলা জড়িয়ে গিয়েছে এই আঁশটে গন্ধ, যাকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বাঙালি তাই সত্যিই “Fishy”।

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও