রবীন্দ্রনাথ; অ্যান্টিক না আজও প্রাসঙ্গিক!

 

রবীন্দ্রনাথ; অ্যান্টিক না আজও প্রাসঙ্গিক!

অমিতায়ু চক্রবর্তী।

রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর উত্তরকালীন সাহিত্য প্রসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত মন্তব্য করেছিলেন, “তাঁর এই অসীম সাম্রাজ্যের অনেক জমি জোতদারের দখলে এসেছে; এবং তাদের মধ্যে যারা পরিশ্রমী, তারা নিজের নিজের এলাকার শস্যের পরিমাণ বাড়িয়েছে মাত্র। ফসলের জাত বদলাতে পারেনি” (কুলায় ও কালপুরুষ)। তাঁর এই মন্তব্যের আলোকেই রবীন্দ্রনাথ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কতখানি প্রাসঙ্গিক, তা বিচার করে দেখা যেতে পারে। নিতান্ত বস্তুবাদী তথা মোটা দাগের এই আণবিক যুগে দাঁড়িয়ে ধরাছোঁয়া যায় না এমন কিছু নিয়ে আলাপ আলোচনাকে অনেকেই বাতুলতা অথবা সময় নষ্ট বলে মনে করেন। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক ভাবনা বা পরম’কে ছুঁতে চাওয়ার বোধিকে স্পর্শ করতে যে মানসিক স্থৈর্য্য প্রয়োজন, তাকে অর্জন করার সময় বোধকরি হয় না আজকের ইঁদুর দৌড়ের শেষের ক্লান্ত বিকেলে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও স্পষ্ট হবে। ‘অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া’ রবিঠাকুর মেঘদূত পড়েছিলেন, আমরা হলে হয়ত ফেসবুক দেখতাম। তাঁর সঙ্গে আমাদের এই মূলগত তফাতটুকুকে বাদ দিলে, শিক্ষায়, বোধে, রুচিতে এবং আধুনিকতায় তাঁকে আমাদের তুলনায় খুব একটা প্রাচীন বলে মনে হয় না। নিজের কন্যাসন্তানদের বাল্যবিবাহ দিয়েছিলেন বলে কেউ তাঁকে মধ্যযুগীয় বলে বিরুদ্ধ যুক্তি দিতেই পারেন কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়েও বাল্যবিবাহটাকে আইন না করে আটকানো যেত না বা আইন স্বত্বেও যে বিয়ের আসরে পাত্রীর বয়স নিয়ে পুরোদমে কারচুপি হয়, তা একটু খোঁজখবর করলেই জানা যায়। অনেক সমালোচককেই দেখেছি সমালোচনা করার সময় ‘style is the man himself’ বাক্যবন্ধকেই একমাত্র সার করে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন ও ব্যক্তিজীবনকে গুলিয়ে সরবত করে ছাড়েন। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হলেও সমাজ বহির্ভূত ছিলেন না বা তার ঘাড়ে একটা পুরোদস্তুর সংসার ছিল- এই ব্যাপারটা হয়ত তখন তাদের মনে থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার আধুনিকতম মাপকাঠিতে কতখানি উতরেছেন, এই নিয়ে যথেচ্ছ আলোচনা হয়েছে, তাতে রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত থেকে শুরু করে তীব্র বিরোধী মোটামুটি সকলেই তাকে আধুনিক বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। অতঃপর আলোচ্য তাঁর প্রাসঙ্গিকতা। সে ক্ষেত্রে একটা পালটা প্রশ্ন হতে পারে, প্রসঙ্গটা আসলে কী! মধ্যবিত্তর বুকশেলফে রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক হলেও সান্ধ্য সিরিয়ালের যুযুধান শাশুড়ি বউমার কাছে নয়। গীতবিতানে বা সঞ্চয়িতায় প্রাসঙ্গিক হলেও গায়ে মাখার সাবানে কিংবা মশার ধূপে নন। রবীন্দ্রনাথ আর পাঁজির একটা পার্থক্য থাকবেই, বিবাহের যোগ থেকে কুষ্মান্ড ভক্ষণ নিষিদ্ধ অবধি তার ব্যাপ্তি হবে না, হতে পারে না- সেইটা মাথায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন এই আলোচনার সময়ে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক বলেই হয়ত এত বছর পরেও ‘রক্তকরবী’র পুনর্মূল্যায়ণ হয়। প্রাসঙ্গিক বলেই হয়ত গীতবিতান আজও বাঙালি বাড়ীর must have এর তালিকাভুক্ত। প্রাসঙ্গিক বলেই হয়ত, পরীক্ষার প্রয়োজনে হলেও আমাদের মনে রাখতে ১৮৬১ আর ১৯৪১ সালদুটো, বৈশাখের ২৫ আর শ্রাবণের ২২ তারিখদুটো। প্রাসঙ্গিক বলেই বাড়ীর বড়দের সামনে গাইবার বা পড়বার সময় ডাইরি হাতড়ে তাঁর লেখা গান বা কবিতা বের করতে হয় খুঁজে। রবীন্দ্রনাথ ভাল’র গ্যারান্টি দেন আমাদের। আগে পিছে রবীন্দ্রনাথ থাকলে সে জিনিস ভাল না হয়ে যায় না- এমন একটা বিশ্বাস এখনও আমাদের আছে। ইংরেজি মাধ্যমের গর্ভজাত কোন ট্যাঁশ তাই এখনও দুম করে ব্যাকডেটেড বলতে পারে না তাঁকে। এর বাইরে যে রবীন্দ্রনাথ, সে হয় গবেষকের না হয় আগ্রহীর। বস্তুবাদী জীবনে আমাদের সেসব নিয়ে ভাবার সময় কি আছে! থাকলে ৮০ বছরের একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন হয়ত চোখে পড়বে, হয়ত কষ্টও হবে। কিন্তু, এর বাইরে আরও যা যা ক্ষয়ে যাচ্ছে, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে বা কোথাও হয়ত অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে যাচ্ছে, তা সাধারণের সাদা চোখে পড়বে না। যাদের পড়বে, প্রাসঙ্গিকতা বিচারের ভোটে তারা কোনমতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। তাই তাদের উপেক্ষা করাই যায়।

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও