নাট্যপ্রযোজনার একটি সমান্তরাল ধারা- 'রবিনাটকের নাট্যকথা'
নাটকের সাহিত্যগত দিকটি বাদ দিলে যে বিরাট অংশটি পড়ে থাকে, সেটি তার প্রকৌশলগত দিক। তাতে শুধু আলো বা মঞ্চসজ্জা নয়, আলোচিত হয় অভিনয়ের রীতি, কুশীলবদের বিশেষ প্রশিক্ষণ বা অনুশীলনের দিকটিও। নাটকের জ্যঁর-কে বুঝে নিয়ে সেইমত নাটকের নির্দেশনা বা প্রযোজনার বিষয়টিও এই প্রকৌশলের অন্তর্গত। নাটকের এই দুটি দিক একদিকে যেমন একে অন্যের পরিপূরক, তেমনি আবার অন্যদিকে এই দুই অংশের বিরোধ অনেক নাটকের অভিনয়যোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে, নাট্য নির্দেশনার বহু ছকভাঙা আদলের জন্ম হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের নাটক সমকালীন তথা প্রচলিত নাটকের তুলনায় গোড়া থেকেই স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্য নাট্যকারের ইচ্ছাকৃত বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজের সৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ব্যাপারে শুরু থেকেই যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। তবে এই স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেও তার প্রথম দিকের নাটকগুলিতে বহমান সংস্কৃতির প্রতি একধরণের আনুগত্য দেখতে পাওয়া যায় যা তার পরবর্তীকালের নাটক অর্থাৎ শান্তিনিকেতন পর্বের নাটকে আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। শান্তিনিকেতন পর্ব থেকেই প্রথাগত নাটকের থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলির দূরত্ব বাড়তে থাকে। নাটকের সাধারণ মানদন্ডকে ছাপিয়ে গিয়ে তা বৌদ্ধিক সুষমায় অনিন্দ্যসুন্দর হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে ক্রমবিবর্তনে দেখা যায় তার শুরু গীতিনাটকে এবং সমাপ্তি নৃত্যনাটকে। নৃত্যনাটকগুলিতে তার কাব্য প্রতিভার স্ফূরণই এক ভিন্ন মাত্রায় যেন প্রকাশ পায়। কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত- এর মতে, “রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাটক ছাড়া আর কোন নাটকেই- পুনর্বার ডাকঘরকে একটি নিবিড় ব্যতিক্রম বলে স্বীকার করি- কথ্য কবিতার প্রচুর স্ফূর্তি নেই”।
রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে রচনাকালের নিরিখে যে তিনটি পর্বে ভাগ করেছেন শঙখ ঘোষ, তার প্রথম পর্বের নাটকগুলিকে বাদ দিয়ে বাকি নাটকগুলির অভিনয়যোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে বলে জানা যায় রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে। অন্য নাটককারদের নাটকের প্রযোজনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটক উপস্থাপনার যে মূলগত ফারাক, তার শিকড় নিহিত রবীন্দ্রনাথের নাটকের বিষয়গত তথা ভাবগত এবং কাঠামোগত অনন্যতায়। রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে একটি ভিন্নতর কনসেপ্ট বা ভাবনার প্রয়োজন হয়, যা অন্য নাটকের ক্ষেত্রে সেভাবে দরকার পড়ে না। ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদী নাটক বাদ দিলে যেমন শেক্সপীয়র বা ব্রেখট এর নাটক অভিনয়ের ক্ষেত্রে এক ভিন্নতর স্কুলিং এর প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রেও তেমনি অভিনয় বা উপস্থাপন শৈলীর এক ভিন্নতর প্রয়োগ বা অভ্যাসের প্রয়োজন হয়। প্রাক-শান্তিনিকেতন পর্বের যে নাটকগুলি, রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব বিশ্লেষণে তা ছিল প্রচলিত ধারার অনুবর্তন, যার সিংহভাগ জুড়ে ছিল ইউরোপীয় নাট্য আদর্শের প্রভাব। কিন্তু পরবর্তীকালের নাটক রচনা ও প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ সেই ধারা বর্জন করেন এবং স্বকীয় একটি ধারার জন্ম দেন, যা প্রাচ্যের সংস্কৃত নাটকের ঐতিহ্য দ্বারা কিয়দংশে প্রভাবিত। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত ধারা বেশ কিছুদিন শান্তিনিকেতনের নাট্য প্রযোজনাগুলিতে অনুসৃত হলেও কিছুকাল পর থেকে তা রসহীন যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়। ফলে কালের নিয়মে অল্পকালের মধ্যেই তার বিলোপ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ সমকালীন পেশাদারি থিয়েটারের একটি সমান্তরাল ধারা তৈরি করেন শান্তিনিকেতনে। যদিও রবীন্দ্রনাথের লেখা নাটক পেশাদারি মঞ্চেও বহুবার অভিনীত হয়েছে তার জীবদ্দশায়। সেই প্রযোজনাগুলির মধ্যে তিনটি ধারা উল্লেখযোগ্য। প্রথম ধারাটি তৈরি হয় অমরেন্দ্রনাথ দত্ত ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফির হাত ধরে, যা মহেন্দ্র গুপ্ত'র সময় পর্যন্ত বহমান ছিল। কবির আশীর্বাদ ধন্য শিশিরকুমার তার অনবদ্য প্রয়োগশৈলী এবং বৌদ্ধিক প্রাচুর্যে এক অননুকরণীয় ধারার জন্ম দিয়েছেন। সবশেষে রয়েছেন শম্ভু মিত্র তথা বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীর প্রযোজনাগুলি যা শম্ভু মিত্রের ভাষায় ‘মঞ্চের কাব্য’, তা এক আধুনিক আঙ্গিক থেকে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে দেখতে শেখায়।
রবীন্দ্রনাথের নাটকে তার নিজস্ব নাট্যভাবনার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় ১৯০৮ সাল থেকে। এর আগে প্রায় বারো বছর তিনি নাটক রচনা বন্ধ রেখেছিলেন। অবশ্য নাটক রচনা বন্ধ রাখলেও তার নাট্যচিন্তা যে থেমে থাকেনি তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯০২ সালে প্রকাশিত তার রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধটিতে, যা রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় নাট্যচিন্তার প্রথম প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ যে এই সময় থেকেই প্রচলিত নাট্যধারার সমান্তরাল তথা বিকল্প একটি নাট্যধারার পরিকল্পনা করেছেন এই প্রবন্ধ তারই প্রমাণ। পাশ্চাত্য রীতিকে অনুসরণ করে বহমান যে নাটকের ধারা, তাকে থেকে বাংলা নাটককে মুক্ত করে সম্পূর্ণ দেশীয় ধারায় এক ভিন্ন রূপশৈলীতে তাকে গড়ে তোলার ভেষ্টা করেন রবীন্দ্রনাথ। তার নাটকের বিষয়বস্তর মধ্যে যেমন দেশীয় ভাবনার এক গভীর প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই সেই নাটকের উপস্থাপনের জন্যেও দেশীয় নাট্যকাঠামোকেই অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩১০ বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকায় প্রাচীন ভারতীয় নাট্যসংস্কৃতি বিষয়ে দুটি নিবন্ধ রচনা করেন। আর একথা রবীন্দ্রনাথ’কে নিয়ে অল্পবিস্তর চর্চা করা মানুষ মাত্রেই জানেন যে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যভাবনার মূলে অনেকখানি জুড়ে ছিল তার জ্যোতিদাদা’র প্রভাব। ফলত এখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের নাট্যচিন্তার অভিমুখটি চিনে নেওয়া যেতে পারে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়েরই নাট্যচিন্তার মূল আকরটি ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে সংগৃহীত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তার প্রবন্ধে লিখছেন “চরিত্রদের পরস্পরের মনে কোনও প্রকার বিকার উৎপাদন করাই নাটকের প্রধানে কার্য এবং তাহার ওপরেই নাটকের নাটকত্ব নির্ভর করে”। নাটকের যে সাধারণ ত্রিমাত্রিক কাঠামো থাকে, রবীন্দ্রনাথ তাতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেন। নাটক সাধারণত কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থেকে শুরু হয়ে একটি চূড়ান্ত বিন্দুতে মিলিত হয়ে অবশেষে ক্লাইম্যাক্সে শেষ হয়। এটিই নাটকের প্রচলিত ছাঁচ। রবীন্দ্রনাথের নাটকে ক্লাইম্যাক্সের পরেও একটি ক্রাইসিস থেকে বোধের জন্ম হয়। এখানেই তার নাটকের অনন্যতা। তার নাটকের এই অনন্যতার পাশাপাশি তার নাটকের প্রয়োগরীতি তাকে আলাদা স্বাতন্ত্র্য দেয়। রবীন্দ্রনাথ তার ১৯০২ সালে লিখিত রঙ্গমঞ্চ প্রবন্ধে প্রোসেনিয়াম মঞ্চ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখেছেন, “ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নাট্যমঞ্চের বর্ণনা আছে। তাহাতে দৃশ্যপটের কোন উল্লেখ দেখিতে পাই না। তাহাতে যে বিশেষ ক্ষতি হইয়াছিল, এরূপ আমি বোধ করি না”। দেশজ যাত্রাসংস্কৃতিকে রবীন্দ্রনাথ মান্যতা দিয়েছেন তার নিবন্ধে। তার মতে, “আমাদের দেশের যাত্রা আমার ওইজন্য ভাল লাগে। যাত্রার অভিনয়ে দর্শক এ অভিনেতার মধ্যে গুরুতর ব্যবধান নাই। পরস্পরের বিশ্বাস ও আনুকূল্যের ওপর নির্ভর করিয়া কাজটা বেশ সহৃদয়তার সহিত সুসম্পন্ন হইয়া উঠে। কাব্যরস সেটা আসল জিনিস, সেইটেই অভিনয়ের সাহায্যে ফোয়ারার মত চারিদিকে দর্শকদের পুলকিত চিত্তের উপর ছড়াইয়া পড়ে। মালিনী যখন তার পুষ্পবিরল বাগানে ফুল খুঁজিয়া বেলা করিয়া দিতেছে তখন সেটাকে সপ্রমাণ করিবার জন্য আসরের মধ্যে আস্ত আস্ত গাছ আনিয়া ফেলিবার কী দরকার আছে- একা মালিনীর মধ্যেই সমগ্র বাগান আপনি জাগিয়া উঠে। তাই যদি নাই হইবে তবে মালিনীরই বা কি গুণ, আর দর্শকগুলোই বা কাঠের মূর্তির মত কী করিতে বসিয়া আছে?”।
প্রমথনাথ বিশীর মতে, নাট্যকাব্য "প্রকৃতির প্রতিশোধ" থেকেই রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব স্টাইল দেখা দিতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার খন্ডিত আত্মজীবনী "জীবনস্মৃতি" তে গোড়ায় গলদ, রুদ্রচন্ড, নলিনী, বৈকুন্ঠের খাতা প্রভৃতি নাটকগুলিকে ইউরোপীয় নাট্যসংরূপ শারাড (Charade) এর অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংলাপের কাব্যধর্মিতা ও দীর্ঘ স্বগতোক্তির ধরণের ফলে পেশাদারি থিয়েটারে বারবার এই নাটকগুলিকে অভিনয় অযোগ্য বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি তার মৃত্যুর পরেও পেশাদারি বা শখের থিয়েটারগুলি রবীন্দ্রনাথের নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে তেমন উৎসাহ দেখায়নি। শান্তিনিকেতন পর্বের আগে যে নাটকগুলি রচিত হয় রথীন্দ্রনাথের ভাষায় তাছিল রোম্যান্টিক ভাবের ঘাত-প্রতিঘাত। এই পর্বের প্রথম যে তিনটি নাটকে রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় নাট্যচিন্তার স্ফূরণ দেখা দেয়, সেগুলি হল- শারদোৎসব, অচলায়তন এবং ফাল্গুনী। প্রচলিত আঙ্গিকে লেখা বিসর্জন এবং রাজা ও রানী নাটক আর অন্যদিকে রাজা ও ডাকঘরের মত রূপকধর্মী নাটকের মাঝখানে উল্লিখিত তিনটি নাটক যেন ঘর এবং বাইরের মধ্যে সেই বারান্দা- যা ছুঁয়ে আছে দু-দিক’কেই। এই নাটকগুলিতে বিষয়বস্তু ক্রমশ শজ এবং সংহত হয়ে এসেছে কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নাটকের মধ্যে রূপকধর্মিতার আভাস পাওয়া যায় যা পরবর্তীকালে একটি সম্পুর্ণ নতুন ফর্মের জন্ম দেয়।
শান্তিনিকেতনে শারদোৎসব নাটকের যে অভিনয় হয়, তা ছিল ড্রপসিন বর্জিত। হাতে আঁকা ড্রপসিন এর বদলে মুক্তমঞ্চের ব্যবহার শুরু হয় এই সময় থেকে। অনেক ক্ষেত্রেই একরঙা নীল সামিয়ানার ব্যবহার হতে থাকে। মুক্ত পরিসরে ড্রপসিন বর্জিত এই অভিনয় প্রচলিত লোকনাট্য যাত্রায় বহুল ব্যবহৃত। সিন বা দৃশ্যপটকে রবীন্দ্রনাথ উপদ্রব বলে অভিহিত করেছেন। তার বদলে নানা রঙের পট্টবস্ত্র, গাছের ডাল, দেবদারু পাতা প্রভৃতি দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় শারদোৎসব নাটকের মঞ্চ। একটি বিষয় লক্ষণীয়, ঋতুনাটকগুলির অন্যতম এই শারদোৎসব অভিনয়ও হচ্ছে শরৎকালেই। ফলে নাটকে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক উপাদানগুলি শরৎকালকেই যেন অধিকতর প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে মঞ্চায়নেও। অর্থাৎ সাহিত্য আর প্রকৌশল মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে এই নাট্যপ্রযোজনায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাজা নাটকে যে সময়কাল বর্ণিত তা বসন্তকাল তথা বসন্তোৎসব এর দিন। রাজা নাটকের অভিনয়ও হত এই দিনই। ফলে রক্তকরবীর গুচ্ছ বা বসন্ত আসার পথে রঞ্জনের আসার খবর প্রাকৃতিক প্রাসঙ্গিকতায় আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।
রবীন্দ্রনাথের নতুন নাট্যচিন্তার প্রথম সফল প্রয়োগ দেখা যায় তার রাজা নাটকে। এই নাটকের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, রাজার দুটি রূপ। ব্যাপ্তরূপ এবং আত্মরূপ। ব্যাপ্তি থেকে আত্মায় উত্তরণ এই নাটকের মর্মবাণী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্তানিসলাভস্কির অভিনয় বিজ্ঞানের মূলসুরটিও কিন্তু একই বার্তা বহন করে। তার চরিত্র নির্মাণের সূত্রেও সেই একই ব্যস্পতি থেকে আত্মার প্রতি গমনের পথনির্দেশ দিয়েছেন তিনি। চরিত্রের অন্তর্নিহিত ব্যক্তিটিকে খুঁজে অভিনেতা যদি সমকালীন প্রাসঙ্গিকতায় তাকে মঞ্চে উপস্থাপন করতে পারেন, তবেই সেই অভিনয় সার্থক হয়। স্তানিসলাভস্কির এই ভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নাটকের উপস্থাপনাগুলির একটি অন্তর্নিহিত এবং আত্মিক যোগ দেখতে পাওয়া যায়। মস্কো আর্ট থিয়েটারে পরিবেশনার জন্যে অন্য অনেক নাটকের সঙ্গে কেন রবীন্দ্রনাথের রাজা-কেও মহড়ার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন স্তানিসলাভস্কি- তা হয়ত পাঠকের বোধগম্য হতে আর অসুবিধা হবে না।
রবীন্দ্রনাথ তার নাটকের প্রযোজনায় অনেক রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। শান্তিনিকেতন পর্বের প্রথম দিকের নাটকে মূলত তিনি মঞ্চসজ্জা বা দৃশ্যপটের ক্ষেত্রে তার ভাবনার অভিনবত্ব দেখালেও পরবর্তীকালের তথা শেষদিকের নাটকে তিনি নাটকের প্রচলিত ফর্মটিকেই ভেঙে ফেলতে চাইলেন। গদ্য সংলাপ পরবর্তী নাটকগুলিতে প্রাচুর্য হারাল এবং গানের সঙ্গে নাচের এক অনবদ্য মিশেলে রবীন্দ্রনাথ জন্ম দিলেন নাটক উপস্থাপনার এক ভিন্নতর ফর্ম। রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটকগুলির মধ্যে যেগুলি অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে রচিত, সেগুলিকে মঞ্চে উপস্থাপনের জন্যে তাই নাটকের প্রচলিত ফর্ম ভেঙে নাট্যকার নির্দেশিত ফর্ম অবলম্বন ছাড়া উপায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথের প্রথাবিরুদ্ধ নাট্যনির্মাণ শুরু হয় শারদোৎসব থেকে। ফাল্গুনীতেও সেই বিকল্প নির্মাণই দেখা যায় তার নাট্যপ্রযোজনায়। একমাত্র ডাকঘর বাদে এই সময়ের সব নাটকই বাহুল্যবর্জিত মঞ্চসজ্জা ব্যবহার করেই করেছেন রবীন্দ্রনাথ। রাজা, অচলায়তন, ফাল্গুনী প্রভৃতি সবকটি নাটকেই এই অনাড়ম্বর অথচ ব্যাঞ্জনাময় মঞ্চসজ্জা লক্ষ করা যায়।
এই আলোচনার সমাপ্তিতে একথা বলা যেতেই পারে, রবীন্দ্রনাথের নাটক তার কাব্যসুষমায় স্বতন্ত্র। কাব্যগুণই এই নাটকগুলির প্রধান চালিকাশক্তি। সেই কাব্যগুণ বজায় রাখতে তিনি তার নাটককে করেছেন উপমার বাহুল্যবর্জিত। সাহিত্যগত দিকে যেমন নির্মেদ তার নাটক, তেমনি উপস্থাপনার বাহুল্যেও যাতে তা ভারাক্রান্ত না হয়, সেদিকেও তিনি যথেষ্ট সাবধানী ছিলেন। প্রচলিত ফর্ম ভেঙে নতুন ফর্ম নির্মাণ বা পাশ্চাত্য রীতির দৃশ্যপট প্রভৃতির বর্জনের পশ্চাতেও কারণ ছিল সেই একটিই। অভিনয় একটি চলমান, গতিশীল বিষয়। দৃশ্যপট জড়বস্তু, স্থানু। তারা কিছুতেই একে অপরের সঙ্গী হতে পারে না। অভিনয়ের অক্ষমতা ঢাকতে তিনি চিত্রশিল্পীর কাছে ঋণী হতে চাননি। দর্শকের কল্পনা যাতে কিছুতেই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নাটকের ব্যাপ্তিকে সীমিত করে তুলতে না পারে, তাই তিনি বাহুল্যবর্জিত মুক্তমঞ্চরীতির প্রবর্তন করেন তার নাটকে। নাটকের ব্যাঞ্জনাকে যান্ত্রিক কৃত্রিমতায় আচ্ছন্ন করে তুলতে নারাজ রবীন্দ্রনাথ বিষয়গতভাবে তো বটেই, উপস্থাপনরীতিতেও যেন কবিতা রচনা করে গেছেন তার নাট্যপ্রযোজনাগুলিতে। পরিশেষে বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ নাটকের মধ্যে কবিতাকে বসাতে চাননি, চেয়েছিলেন তাকে কাব্যগুণসম্পন্ন করে তুলতে। কবিতাই যে একমাত্র পারে মানুষের মনের গভীরতর অনুভবকে ব্যাঞ্জনার মাধ্যমে প্রকাশ করতে- এই বোধ থেকে তিনি নাটককে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি। নাটক যে শুধুই দেখার নয়, তার প্রভাব চোখ থেকে সঞ্চারিত হতে পারে মনে, মননে, জন্ম দিতে পারে কাব্যিক সুষমার- এই কাব্যিক সত্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ছকভাঙা নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমার অসাধারণ লাগল।
ReplyDeleteঅমিতায়ু বাবু,
ReplyDeleteজুন ১৭, ২০২১ তারিখের আপনার লেখা ‘নাট্যপ্র্যজনার একটি সমান্তরাল ধার – ‘রবিনাটকের নাট্যকথা’’ blog টি আমার নজরে এল হঠাতই। এবং যার পর নাই বিস্মিত হলাম লেখাটি পড়ে।
Plagirarism এর এটি একটি আদর্শ নিদর্শন। ‘রবিনাটকের নাট্যকথা’ শিরনামে আমার লেখা বইটি থেকে প্রচুর খেটে আপনি বিভিন্ন অংশ নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে এবং বিনা অনুমতি বা ঋণ স্বীকার না করেই সুচতুর ভাবে টুকে যে একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ দাঁড় করিয়েছেন, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে উপায় কী বলুন?
তবে যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমার এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে, বিষয়টি তাঁদের নজরে এলে তাঁরা কী পদক্ষেপ নেবেন – কী সব গ্রন্থস্বত্ব আইন-টাইনের ব্যাপার আছে না – তা বলা অবশ্য মুশকিল।
তবে সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, আপনার যোগ্যতা ছিল এই বিষয়ে পড়াশুনো করে একটি স্বকীয় লেখা তৈরি করার।
পরিশেষে বলি, একজন আলোচক ও লেখক হিসেবে নাটক এবং নাট্য বিষয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা, যৎকিঞ্চিত পড়াশুনো, এবং একজন দর্শক হিসেবে অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বেশ কয়েক দশক সময়কাল পেরিয়েছে। অনুমান করি আপনার বয়স অল্প তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি একটি বই থেকে টুকে নিজের চিন্তার ফসল বলে চালিয়ে দেওয়াতে কি নিজেকেই ফাঁকি দিয়ে নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে পড়লেন না?
শুভেচ্ছা জানাই যাতে নিজের ভাষায়, নিজের উপলব্ধ জ্ঞানকে পুঁজি করে পরবর্তি লেখাগুলি করতে পারেন, আর অন্যের লেখা থেকে নিলে তা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করার সৎসাহস দেখানোর দ্বিধা যেন না থাকে।
সুব্রত ঘোষ
সুব্রত বাবু, এই লেখাটি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন্যাল তথা গবেষণা সন্দর্ভ হিসেবে লেখা। সেখানে যথাবিহিত নিয়ম মেনে আমি আপনার বই-এর নাম ও তথ্যসূত্রে তার বিশদ বিবরণ উল্লেখ করেছি। লেখাটি যাতে হারিয়ে না যায়, সেই কারণেই এখানে তা কপি করে রেখেছি।
Delete