দেশের ভাগ, নারীর বাঁটোয়ারা ও সাদাত হাসান মান্টো : অগ্নিগর্ভ দিনের “ঠান্ডি” অনুবাদ

দেশভাগ শব্দটিকে বাঙালিরা যে অর্থে বুঝতে বা ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, তাতে শব্দটির আভিধানিক অর্থ এশ খানিকটা বদলে যায়। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্রে দেশভাগ চর্চা বা পার্টিশন স্টাডিজ নামক যে নব্য শাখাটির আগমন হয়েছে, তাতে মূলত দেশভাগের প্রেক্ষিত, দেশভাগ সংক্রান্ত ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক নথি ও সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে দেশভাগের প্রভা তথা দেশভাগের ট্রমা নিয়ে আলোচনা হয় নানা তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। বলা বাহুল্য, এই চর্চার ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। তার আগে পর্যন্ত দেশভাগ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে পন্ডিত মহল ও সাধারণ লোকমানসে একটি স্পষ্টতর পার্থক্য দেখা যেত। পন্ডিতেরা আলোচনা করেছেন সন-তারিখ-সীমানার ভিত্তিতে, কখনও বা সমকালীন রাজনীতি বা কূটনীতির দৃষ্টিকোণে, কেউ বা তাকে দেখতে চেয়েছেন বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে, অন্যদিকে সাধারণ লোকমানসে দেশভাগ শুধুই যন্ত্রণার স্মৃতিবাহী, আতঙ্কের চিহ্নস্বরূপ। 

দেশভাগ তথা পার্টিশনের আলোচনায় এখন স্পষ্টতর দুটি বিভাজনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। প্রথমটি হল পাঞ্জাব পার্টিশন ও দ্বিতীয়টি হল বেঙ্গল পার্টিশন। এ বিষয়ে চর্চাকারীমাত্রেই জানেন যে পাঞ্জাব পার্টিশন যতখানি well documented, বেঙ্গল পার্টিশন ততখানি নয়। পাঞ্জাব পার্টিশন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য আর্কাইভে সঞ্চিত এবং গবেষকেরা চাইলে গবেষণার ক্ষেত্রে তা ব্যবহারও করতে পারেন, কিন্তু বেঙ্গল পার্টিশনের ক্ষেত্রে এমনটি হবার তেমন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে গবেষণার অন্যতম প্রধান উপাদান হল পার্টিশনের প্রেক্ষিতে রচিত গ্রন্থাদি, সেই সময়ে লেখা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত নানা খবর ও প্রায় ধূসর হয়ে আসা কিছু মানুষের স্মৃতি। বইগুলি বহুচর্চিত ইতিহাসের কথা বলে। আর বাকি উপাদানগুলি সাময়িক আবেগ বা রাজনৈতিক চাপান-উতোরের ভারে এতখানি ভারাক্রান্ত, যে তা থেকে গবেষণার উপযোগী পরিশুদ্ধ আকর সংগ্রহ করা দুষ্কর। 

দেশকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করার একটি প্রবণতা ঐতিহ্যের মতই উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে বর্তমান। জননীর স্থান যতই স্বতন্ত্র হোক, তিনি প্রাথমিকভাবে একজন নারী। তাই সেদিক থেকে দেশের বিভাজন একপ্রকার নারীরও বিভাজন। প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর বিদ্যাশিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক কর্মে পুরুষের মত সমানাধিকার থাকলেও নব্য বৈদিক যুগ থেকেই তাকে পুরুষের কামনা চরিতার্থ করার উপাদান ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বর্ণভেদে নারীর কোন স্থান নেই- সে পঞ্চম বর্ণ। নব্য বৈদিক যুগের কাল থেকেই নারীর উপস্থিতি, নারীর মূল্য শুধুমাত্র তার দেহে। সে পুরুষের ভোগ্যপণ্যমাত্র। আর তাই আমাদের শাস্ত্রকারেরা “পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা” বিধান দিতে এতটুকুও কুন্ঠিত হন না। এই বিধানের মধ্যেই যে নারীমাংসলোলুপ সমাজের কামাতুর পাশবিক রূপটি লুক্কায়িত ছিল, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। অনুসারী ঐতিহ্যে সেই অন্ধত্ব সঞ্চারিত হয়েছে আধুনিক সমাজপতিদের মধ্যেও। তাই আজও নারীর বর্ণনা হয় second sex হিসেবেই। 

এই আদিম অন্ধকারের সামনে লেলিহান অগ্নিশিখার মতই মান্টোর অবস্থান। আর সেই কারণেই তাঁর দেশের সরকারের কাছে মান্টো বিপজ্জনক, সরকারি ভাষায় “প্রতিক্রিয়াশীল”। পার্টিশন শব্দের আভিধানিক তথা প্রায়োগিক অর্থ বিভাজন হলেও সেই বিভাজনের আড়ালে লুকিয়ে ছিল কিছু ঐক্যও। জাতি-ধর্মের নিরিখে আলাদা হওয়ার সেই হুজুগে এক হয়ে গিয়েছিল অসহায়মানুষের কান্না, সব হারানোর হতাশা, ধর্ষিতা নারীর আর্তনাদ ও ধর্ষকের লালসা। কোন হিন্দু মুসলমানের বিভাজন তাকে রুখতে পারেনি। মানুষের আদিম ও পাশবিক যে রিপু সমাজের সভ্যতার চাপে অবদমিত ছিল, তার ঘৃণ্যতম মুক্তি ঘটে এইসময়ে। মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি পাশবিক যৌনলিপ্সা ও ইয়ভিচার তার নগ্নতম খ্যামটা নেচেছিল কাঁটাতারের বেড়ার আড়ালে। মান্টো তাই আদালতের বিচারপতিকে বলেছিলেন, “একজন লেখক তাঁর কলম হাতে তুলে নেন যখন আহত হয় তাঁর সংবেদনশীলতা”। আহত হবার সেই অপমানের প্রতিশোধ নিলেন মান্টো সেই পশুদের মুখে “ঠান্ডি গোস্ত” ছুঁড়ে মেরে। তার এই ছুঁড়ে মারার কায়দাটিও ছিল অবিশ্বাস্য রকমের নিরাসক্ত। অন্ধকারের মুখে জ্বলন্ত অঙ্গার ছুঁড়ে মারার শাস্তি মান্টো পেলেন। তাই কখনও তার জায়গা হল হাসপাতালে, কখনও জেলে, কখনও বা পাগলাগারদে। সেই প্রাচীরে কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেলেও থামেনি মান্টোর কলম, থামেনি প্রতিরোধের স্পর্ধা। অবিশ্বাস্য নিরাসক্ত ভঙ্গীতে মান্টো একের পর এক এঁকে গিয়েছেন ভয়াবহ জীবনের ছবি, প্রকৃতির মত চির-উদাসীন ভঙ্গীতে তিনি ধারণ করেছেন, দৃশ্যায়ণ করেছেন বহুবর্ণ জীবনের কথা। একটি শিশু যেমন করে নিরপেক্ষ উদাসীন বিস্ময়ে পৃথিবীকে দেখে, ঠিক সেভাবেই যেন মান্টোর গল্পে পাঠক দেখেন, বিভাজন-উত্তর শরণার্থীর ভিড়, দেখেন রক্ত, আগুন, দেখেন ধর্ষিত নারীদেহ। 

মান্টো বুঝেছিলেন, দেশভাগ বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা- এর কোনটাই পরিকল্পিত পদক্ষেপ নয়, এর উদ্ভব হয় ক্ষণিক আবেগ বা মুহূর্তের উত্তেজনা থেকে। যে উন্মাদনার বশবর্তী হয়ে মান্টোর গল্পে কাসিম হত্যা করে তার বন্ধুকন্যা বিমলা’কে। সেই হত্যার রক্তে হাত রাঙিয়ে কাসিমের মনে হয় তার ধর্ষিতা কন্যা শরিফানের আত্মাকে শান্তি দিতে পেরেছে সে। যে উত্তেজনায় হিন্দু পরিবারের ওপরে মুসলমান পরিবারের অত্যাচারের ঘটনা শুনতে শুনতে মান্টোর বাল্যবন্ধু শ্যাম চায় তাকে খুন করতে। তবে দেশভাগের এই ডামাডোলের সবকিছুই ক্ষণিক ছিল না। এই ক্ষণিকের ভিড়ে শাশ্বত হয়ে ছিল একটি আদিম সত্য- নারীমাংস যে কোন ধর্মে এবং যে কোন মর্মে উপভোগ্য ও লোভনীয়। যে লোভের আওতায় এক হয়ে গিয়েছিল ধর্ষক ও স্বেচ্ছাসেবী। মান্টোর ‘খোল দো’ গল্পের সেই বন্দুক হাতে ছুটে বেড়ানো স্বেচ্ছাসেবী তরুণেরা এই লোভের বশবর্তী হয়েই ভয়ে ছুটে বেড়ানো সাকিনাকে তুলে নিয়েছিল ট্রাকে, দিয়েছিল খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয়- আর তারপর, শরণার্থী হাসপাতালে এসে ট্রাক থেকে নেমেছিল সাকিনার প্রায়-অচৈতন্য যন্ত্রণাকাতর দেহ। এভাবেই সমাজের জীর্ণ মুখোশের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসা বীভৎসতাকে বারবার মান্টো টেনে এনেছেন প্রকাশ্য দিবালোকে। ভীতা হরিণীর মত নিজের আব্রু বাঁচিয়ে ছুটে বেড়ানো সাকিনা তাই ট্রাক থেকে নামার পর ডাক্তারের জানলা খোলার ধমক শুনে আধো চেতনায় নিজেকে অতিকষ্টে উন্মুক্ত করে দেয় আরও একটি ধর্ষণের জন্যে। 

১৯৪৭ সালে দেশের হয়েছিল ভাগ, যা করেছিলেন সেসময়ের তাবড় রাজনীতিজ্ঞরা আর নারীর হয়েছিল বাঁটোয়ারা, যে নারী শুধুই লোভনীয় মাংসপিন্ড, যা ধর্ম-বর্ণ বিভাজনের উর্দ্ধে। শুধুই পুরুষের ধর্ষকাম চরিতার্থ করতেই তার জন্ম ও বিকাশ, শাস্ত্রকারদের মতে সে “পুত্রার্থে ক্রিয়তে”। নারীর বাঁটোয়ারার সেই মহাযজ্ঞে যারা ছিলেন পুরোহিত ও যজমান, তারা না হিন্দু না মুসলমান, তাদের পরিচয় একটাই- তারা ধর্ষক। দেশ ভাগ হোক বা অখন্ড থাক, তা নিয়ে তদের মাথাব্যথা ছিল না, তারা চেয়েছিল বিভাজনের অরাজকতার আড়ালে আদিম পাশবিক কামনা চরিতার্থ করার আড়াল। আর মান্টো সেই অন্ধকার সন্ধানী জীবদের গায়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন জ্বলন্ত অঙ্গার। সর্বজনবিদিত আলো নয়, আকাঙ্খিত স্বর্গ নয়, মান্টো তার লেখনীতে সন্ধান করেছেন নরকের, খুঁজেছেন অন্তহীন অন্ধকারকে। তাই নিজেকে মান্টো বলেছেন সেই পতিত দেবদূত, যে একবার ঈশ্বরকে অমান্য করেছিল। তিনি আলোর সন্ধানী নয়, তাই তার কথায় বা কলমে নেই নম্রতার ছোঁয়া। তাই তিনি মুক্তকন্ঠে প্রশ্ন করতে পারেন, ধর্মের নামে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে যে মেয়েগুলিকে ধর্ষণ করা হল, বিভাজিত দেশের মানচিত্রে কি হবে তাদের এবং তাদের গর্ভস্থ সন্তানদের অবস্থান? কোন দেশের নাগরিক হবে তারা? কে নেবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব? মান্টোর প্রশ্ন বিদ্ধ করে সমাজকে, মেকি সভ্যতার আবহকে। ছিন্নমূল হয়ে লুটিয়ে পড়ে আজন্ম লালিত সভ্যতা ও সংস্কার। আর সবকিছু ছাপিয়ে জেগে থাকে এক ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ মানুষের প্রশ্ন – “সন্তানগুলিকে ন-মাস গর্ভে ধারণ করার জন্য মেয়েগুলিকে বেতন দেবে কে? ভারত না পাকিস্তান? না কি সেসব লেখা থাকবে ভগবানের খাতায়? সেখানে এখনও কোন পৃষ্ঠা খালি আছে?”।

অমিতায়ু চক্রবর্তী। 

Comments

Popular posts from this blog

চড়ুকে পিঠ (পর্ব-৪)— ত্রিপুর রাজার বিনা নিমন্ত্রণে

হারিয়ে খুঁজি তোমায়; তোমার মত

বাস করিনি কোথাও